=মতিউর রহমান ফয়সাল =

আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করেনি এমন মানুষ পাওয়া কঠিন। দুঃখ, কষ্ট অভিমান জমে অনেকেরই কোন না কোন সময় মনে হয় নিজেকে শেষ করে দিলেই হয়তো সমাধান!

২০১১ সালের কথা। আমার বন্ধু জসিম (ছদ্দনাম) প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, চরম অপমানের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আমার কাছে যখন শেয়ার করলো আমি তাকে তেমন কিছু বলিনি! তাকে বললাম, চল ঘুরে আসি। তাকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘন্টাখানিক অহেতুক ঘুরেছি, অপরিচিত রোগীদের কাছে নিয়ে পরিচিতর ভান ধরে নানা ধরনের কথা বলেছি, দুঃখের কথা, দরদের কথা বন্ধুকে শুনিয়েছি। দুপুরে খেয়ে শহীদ মিনারের সামনে বসে দুজন মানুষের জীবনযাপন দেখে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পর জিজ্ঞাস করলাম, কখন সুইসাইড করবি? সে বললো, সুইসাইড করবে না, মানুষ অনেক দুঃখে কষ্টে জীবন কাটিয়ে বেঁচে আছে, সেখানে তার আত্মহত্যার কারনটি খুবই গৌণ। বর্তমানে সে একজন ভাল শিক্ষক ও পরিবার নিয়ে সুখী মানুষ। হতাশা কাওকে ইস্পাতের মতো শক্ত করে, আবার কাওকে ধ্বংস করে দেয়।

আমি কোন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ নই, আত্মহত্যা বিষয়ে কোন গবেষকও নই তবে জীবন ধারনে দক্ষতা বৃদ্ধি, তরুণ্যের মানোন্নয়নে কাজ করার সুযোগ এবং আত্মহত্যা প্রতিরোধে নানা কাজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে এই লেখাটি লেখছি।

বর্তমান যুগে টিনেজারদের অভিমানকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিন, আপনার কাছে যা মূল্যহীন তাদের কাছে তার গুরুত্ব আকাশসম। অন্যায় আবদার করলে বুঝান, সময় নিন। মুখের উপর না, শাসনের নামে নির্যাতন, সবকিছুতে দোষ ধরা বন্ধ করুন।

দিনেরপর দিন একজনকে হতাশাজনক কথা বলা, নেতিবাচক ব্যবহার, পরিবার থেকে তাচ্ছিল্য, অবহেলা, অযথা মারধোর করা, সবকিছুতে না বলার অভ্যাস মানসিক ভাবে ধ্বংস করে দিতে পারে মানুষকে। যার পরিণতি আত্মহত্যা। তাই শিশুদের বিকাশের সময় তাদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা সফলতার মতো ব্যর্থতাকে মেনে নিতে পারে।

আপনার পরিচিত হতাশাগ্রস্থ ব্যক্তির চোখের দিকে তাকান, তার শারিরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের খোঁজ নিন। মানুষের সবচেয়ে বড় আপনজন মানুষ, আবার সবচেয়ে বড় শত্রুও মানুষ। একাকিত্ব গুচাতে, সমস্যার সমাধান করতে তাই সময় দিন, সুযোগ দিন, সহযোগি হোন। যে ব্যক্তি সমস্যা সমাধানে মৃত্যুর মাধ্যমে পরিত্রাণ পেল সে কোনদিন জানতে পারবে না যে তার সমস্যার সমাধানে অনেক খোলা দরজা ছিল, তাই আগেই বুঝাতে হবে।

টিনেজারদের অভিমান, হতাশা কষ্ট লাগবে তাদের পড়াশোনার পাশাপাশি ধর্ম চর্চা, ক্রীড়া চর্চা, ভাল সংগঠনে যুক্ততা, সৃজনশীল কাজে মনোনিবেশ ও সঠিক গাইডলাইন দিন।

এক জরিপে দেখা গেছে, ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী ছেলে মেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। সুতরাং তরুণ বা বয়ঃসন্ধিকালের ছেলে মেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তুলনামূলক ভাবে অনেক । আবার বয়স বাড়ার পরও ৫০ বা ৬০ বছর হওয়ার পরও মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেড়ে যায়। বাচ্চাদের হতাশা বা ডিপ্রেশন এর জন্য দায়ী বাবা মা, টিনেজারদের হতাশার জন্য দায়ী বাবা মা, শিক্ষক বা নতুন সম্পর্কে জড়ানো, ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ায় হস্তক্ষেপ বা আক্ষেপ। বয়স্কদের ডিপ্রেশন এর জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজেরাই দায়ী। কারন সমস্যার সমাধান তাদের কাছে থাকলেও অধৈর্য হয়ে নিজেরা উদ্যোগী হয়না। তাই সঠিক সময়ে প্রয়োজন সঠিক পরামর্শ, প্রয়োজনীয় মোটিভেশন, জরুরি অবস্থায় বিশেষজ্ঞ দ্বারা কাউন্সিলিং। তা না করে যদি মনে করেন আপনার শাসন, চাপ, না বলার সংস্কৃতিই সব সমাধান করে দিবে তাহলে আপনি আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারী হিসেবেই চিহ্নিত হবেন। সমস্যার কথা আগে মন দিয়ে শুনুন, পরে বলুন।

আত্মহত্যার চিন্তা দূরে রাখতে আপনার পছন্দের কাজ করুন, পছন্দের প্রিয় ভাল মানসিকতার মানুষের সঙ্গে থাকুন। প্রয়োজনে জোর করেই তা করতে হবে। নিজেকে বলতে হবে আমি ভালো থাকবো। আপনার চারপাশে এরকম অনেক মানুষ পাবেন যাঁরা সত্যিই সমস্যার মধ্যে রয়েছেন, অনেক বেশি খারাপ রয়েছেন। সেখান থেকে অনুপ্রেরণা নিন।

পরিবারকে সময় দিন, নিজের মতো করে মানিয়ে নেওয়া অভ্যেস করুন। সর্বোপরি প্রতিজ্ঞা করুন নিজেকে অন্যের অনুরপ্রেরনার উৎসে পরিণত করতে।

পৃথিবীতে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি রয়েছেন যারা জীবন চলার পথে আত্মহত্যায় উদ্যোগী হয়ে ফিরে এসেছেন এবং বেঁচে থেকে ইতিহাসের অংশ আজ নিজ কর্মগুণে। আর্থিক দৈন্যতা, বেকারত্ব, পারিবারিক সমস্যা, সম্পর্কের টানাপোড়ন, একাকিত্ব এসব জীবনের সাময়ীক সমস্যা। সমাধানে হয়তো সময় লাগে কিন্তু অসম্ভব নয়।

টিনেজারদের অভিমান, হতাশা কষ্ট লাগবে তাদের পড়াশোনার পাশাপাশি ধর্ম চর্চা, ক্রীড়া চর্চা, ভাল সংগঠনে যুক্ততা, সৃজনশীল কাজে মনোনিবেশ ও সঠিক গাইডলাইন দিন। আত্মহত্যা প্রতিরোধে নিজেকে অন্যের সামনে অনুরপ্রেরনার এক অধ্যায় হিসেবে পরিবেশন করুন, জীবনটাই বদলে যাবে।

লেখকঃ মতিউর রহমান ফয়সাল

আইনজীবী, সংগঠক ও লাইফ কোচ।