কেন্দুয়া প্রতিনিধি : নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার বার বার দেশের দ্রুততম খেতাবপ্রাপ্ত নাসিম একজন দরিদ্র বাবার সন্তান। তার বাবা হাঁস-মুরগির ব্যবসা করেন। তাদের সাত সদস্যের পরিবারে অভাব-অনটন সব সময় লেগেই থাকে। তবু দমে যায়নি নাসিম। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে দেশের দ্রুততম মানব হওয়ার রেকর্ড অর্জন করেছে বার বার। যার কথা বলছি সে হলো নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার মোজাফরপুর ইউনিয়নের গগডা গ্রামের বাবুল ইসলামের ছেলে ও মজলিশপুর মোহাম্মাদ আলী সিদ্দিকী কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র মো.নাসিম। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে গত ১ ও ২ এপ্রিল ঢাকার মিরপুর সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজ মাঠে বঙ্গবন্ধু জাতীয় জুনিয়র অ্যাথলেটিক্স ও সাঁতার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ওই প্রতিযোগিতায় নেত্রকোনা ক্রীড়া অফিস মাধ্যমে ময়মনসিংহ বিভাগীয় ক্রীড়া অফিস হয়ে অংশ নিয়ে নাসিম ১০০ মিটার এবং ২০০ মিটার দৌড়ে অংশ গ্রহণ করে দুটি পর্বেই প্রথম স্থান অর্জন করে ফের দেশের দ্রুততম মানব খেতাবে ভূষিত হয়। তাকে পুরস্কার হিসেবে সোনার মেডেল ও প্রাইজমানি দেওয়া হয়েছে। নাসিমের এমন সাফল্যে উৎফুল্ল তার পরিবার, শিক্ষক, সহপাঠী, এলাকাবাসীসহ স্থানীয় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনও।

নিজস্ব তেমন কোনো সহায়-সম্পত্তি না থাকায় নাসিমের বাবা বাবুল ইসলাম দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে স্থানীয় চিরাং বাজারের একটি জড়াজীর্ণ ঘর ভাড়া নিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে কোন রকমে দিন যাপন করে আসছেন। এখানে থেকেই তিনি হাঁস-মুরগি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। শনিবার (৯ এপ্রিল) দুপুরে নাসিমদের বাসায় গেলে কথা হয় তার পরিবারে সাথে। এ সময় বাবা বাবুল ইসলাম বলেন স্ত্রী জুবেদা আক্তার, দুই ছেলে ও তিন মেয়ে নিয়ে তার ৭ সদস্যের পরিবার। জমিজমা বলতে তেমন কিছুই নাই। গ্রামের বাড়িতে মাথা গুজার ঠাই থাকলেও একটি ঘর বাঁধার তার সামর্থ্য নেই। হাঁস-মুরগির ব্যবসা করে কোনো রকম সংসার চালাই। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি আরো বলেন, সংসারে সারাবছর টানাটানি লেগেই থাকে ঘর (বাঁধভাম) বাঁধবো কি দিয়ে। তিনি বলেন, তার মেজ সন্তান নাসিম ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি প্রবল আগ্রহী। স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি সে সব সময় খেলাধুলা চর্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকত।

এ বছর নাসিম এসএসসি পরীক্ষা পাশ করেছে। তাকে মজলিশপুর মোহাম্মাদ আলী সিদ্দিকী কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি করে দিয়েছি। নামীদামী কলেজে ভর্তি করাতে হলে তো অনেক টাকা লাগবে। (অত) এত টাকা (কই) কোথায় (পাইয়াম) পাবো। এইজন্যে তাকে বাড়ি কাছে কলেজে ভর্তি করেছি। এর আগেই সে দেশের দ্রুততম মানব হয়ে রেকর্ড অর্জন করেছে কয়েকবার। এতে আমরা গর্বিত। টাকার অভাবে আমি তাকে সহযোগিতা করতে পারিনি। সে নিজের চেষ্টায় এতদূর এগিয়েছে। সহযোগিতা পেলে হয়তো সে দেশের বাইরে গিয়েও বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারত। নাসিমসহ তিন মেয়েকেও প্রাইমারি স্কুলে পড়ালেখার সময় বিভিন্ন ক্রীড়ানুষ্ঠান ও জাতীয় দিবসে অংশগ্রহণ করে খেলাধুলার প্রতি তার আগ্রহ বাড়তে থাকে।

২০১৭ সালে কেন্দুয়া পৌরশহরের সায়মা শাহজাহান একাডেমীতে ৬ষ্ট শ্রেনিতে ভর্তি করা হয় তাকে। ওই বছরেই নাসিম প্রথমে উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে সেরা হয়েছে। সে জাতীয় পর্যায়ে সেরা হয়ে দেশের দ্রুততম মানব হওয়ার রেকর্ড করেছে কয়েকবার। এ পর্যন্ত সে ৭০ থেকে ৮০টি মেডেলসহ বহু পুরস্কার অর্জন করেছে। এতে আমরা খুবই আনন্দিত। ভবিষ্যতে সে যেন দেশের জন্য খেতাব অর্জন করে বিশ্বসেরা হতে পারে, এ জন্য সবার কাছে দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।

নাসিম বলেন, গত ১ ও ২ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু জাতীয় জুনিয়র অ্যাথলেটিক্স ও সাঁতার প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার ও ২০০ মিটার দৌড়ে ময়মনসিংহ বিভাগীয় ক্রীড়া অফিস অধীনে অংশ নিয়ে প্রথম হয়ে আবারো দেশের দ্রুততম মানব হওয়ার রেকর্ড অর্জন করি।

গত বছর নেত্রকোনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার হয়ে আমি গত ২২ ও ২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত এই প্রতিযোগিতা অংশ নিয়ে ১০০ মিটার (বালক) দ্রুততম মানব অ্যাথলেট হওয়ার রেকর্ড গড়তে সক্ষম হয়েছি। এতে আমার সময় লেগেছিল ১১.০০ সেকেন্ড। এ ছাড়া ২০০ মিটারেও আমি প্রথম স্থান অর্জন করেছি। এতে সময় লেগেছিল ২২.৪০ সেকেন্ড। আমি ছোট বেলা থেকেই নিয়মিতভাবে লেখাপড়ার পাশাপাশি ক্রীড়াচর্চা চালিয়ে যাচ্ছি। এর আগেও আমি মাধ্যমিক পর্যায়ে ৪৯তম শীতকালীন জাতীয় স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা- ২০২০ অংশ নিয়ে ১০০ মিটার দৌড় ও লম্বা লাফে বিভাগীয় পর্যায়ে সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হই।

নাসিম বলেন, প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় ১৬ ডিসেম্বর, ২১শে ফেব্রুয়ারি ও ২৬ মার্চ জাতীয় প্রোগ্রামে খেলাধুলা হতো। এসব খেলাধুলায় অংশ নিয়ে সব সময় আমি প্রথম হয়েছি। এর পরে আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অংশগ্রহণ করে প্রথম হই। এভাবেই ক্রীড়াচর্চার প্রতি আমার আগ্রহ বাড়তে থাকে এবং মা-বাবাসহ স্কুলের শিক্ষকদের অনুপ্রেরণা পাই। নাসিম বলেন, জেলার সর্ববৃহৎ উপজেলা কেন্দুয়া। অথচয় কেন্দুয়ায় অ্যাথলেট ক্রীড়াচর্চা ও জীম করার মতো তেমন কোন পরিবেশ নেই। ক্রীড়াচর্চার জন্য প্রায়ই কিশোরগঞ্জে আজহার একাডেমীতে যাই। ওইখানে স্যারগণ আমার খুব আন্তরিক ও অনুপ্রেরণা দেন। কিশোরগঞ্জে আশা-যাওয়া করতে দুই-আড়াইশ টাকা লাগে তাইনপ্রতিদিন যেতে পারিনা। ক্রীড়াচর্চা জন্য উপযোগী একটি ক্রীড়াঙ্গন নির্মাণ করা হলে আমার মতো আরো অনেক অ্যাথলেট কেন্দুয়ায় সৃষ্টি হবে।

নাসিম আরো বলেন, এখন আমার মূল লক্ষ্য হলো আমি বাংলাদেশের হয়ে অলিম্পিক প্রতিযোগিতা অংশগ্রহণ করে খেলাধুলায় সেরা হয়ে দেশের সুনাম বয়ে আনতে চাই। এ জন্য সবার দোয়া চাই।