জামালপুর সংবাদদাতা : যমুনার নদীভাঙনে নিঃস্ব হাজার হাজার মানুষ। প্রকৃতির ভাঙা-গড়ার খেলায় পড়ে এসব মানুষের ঠাঁই হয় আবার যমুনার চরেই। চেষ্টায় ভর করে প্রকৃতিই আবার তাদের করে ঐশ্বর্যবান। এমনই যমুনার চরের নিঃস্ব মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। জামালপুরের চরের মানুষ পশু পালন ও চাষাবাদ করে দিন ফেরাচ্ছেন। উন্নতমানের বীজ ও চাষাবাদের আধুনিক কলাকৌশল শিখে আগের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি ফলন পাচ্ছেন। পাচ্ছেন ফসলের ন্যায্যমূল্যও। আধুনিক পশুপালন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে স্বল্প সময়ে পশু মোটাতাজা করে দেখছেন লাভের মুখ। তবে এক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে রয়েছেন। কথা হয় চর মুগরীর বাসিন্দা আছিয়া খাতুনের সঙ্গে। তার দুটি সন্তান। ছেলের বয়স ৯ ও মেয়ের ৫ বছর।
খোলাবাড়ীতে বাড়ি ছিল, যমুনা নদীভাঙনে ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। এখন ঠিকানা হয়েছে চর মুগরীর হাটের ভাড়া জমিতে। স্বামী রুহুল আমীন বেকার। আছিয়া এইচএসসি পাস। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা দিয়েছেন। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও মৌখিকে টেকেননি। তিনি গবাদিপশু পালন করে সংসারের হাল ধরেছেন। পশু পালনের উন্নত ব্যবস্থাপনা শিখে অল্প সময়ে লাভের মুখ দেখছেন তিনি। আছিয়া বলেন, ‘সর্বশেষ আমি ৬৯ হাজার টাকা দিয়ে কিনে তিন-চার মাস পালনের পর এক লাখ ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জামালপুরের সাত উপজেলায় মোট চরের আয়তন ৪৭ হাজার ৮৯৩ হেক্টর। এর মধ্যে জামালপুর সদরে ৮ হাজার ৫১ হেক্টর, সরিষাবাড়িতে ৮ হাজার ৩৩০ হেক্টর, মেলান্দহে ৬ হাজার ১৫০ হেক্টর, ইসলামপুরে ৮ হাজার ২৫০ হেক্টর, দেওয়ানগঞ্জে ৭ হাজার ৩৫০ হেক্টর, মাদারগঞ্জে ৫ হাজার ১০০ ও বকশীগঞ্জে ৪ হাজার ২৬২ হেক্টর চরাঞ্চল রয়েছে। জামালপুর সদর থেকে দেওয়ানগঞ্জের দূরত্ব ৪২ কিলোমিটার। দেওয়ানগঞ্জের মন্ডলের বাজার থেকে উত্তরের দিকে চলে গেছে একটি রাস্তা। ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে এগোলে গাছপালা হালকা হতে থাকে। বাড়তে থাকে বালুময় মাটি। রাস্তার দুই পাশে চোখে পড়বে শুধু দ্রুত বর্ধনশীল ইউক্যালিপ্টাস গাছ। এটা চিকাজানী ইউনিয়ন। প্রায় তিন কিলোমিটার গেলে এ রাস্তার মাথায় খোলাবাড়ী বাজার। এরপরই যমুনার চর। পাশে রয়েছে চর মুগরী।
আছিয়ার মতো এ গ্রামের মমতা বেগম ও শিরিনা বেগমও গরু পালন করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। শিরিনা বেগম বলেন, ‘আমরা গরু কিনে তিন-চার মাস লালন পালন করে বিক্রি করি। ভালোই লাভ হয়। গরুরে ঘাস খিলাই, নিজেরাই ঘাস চাষ করি। সময়মতো টিকা দেই। অল্প দিনেই তাজা করে গরু ছাইড়া দেই।’ তিনি বলেন, ‘মাস তিনেক আগে একটা গরু বিক্রি করেছি। ৫০ হাজার দিয়ে কিনছিলাম, তিন মাস পালার পর ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করি।’

ছালমা বেগম বলেন, ‘ভুট্টা চাষ করে আমরা লাভবান হচ্ছি। আগে এক বিঘায় ভুট্টা হতো ২০ থেকে ২৫ মণ, উন্নতমানের বীজ ও চাষাবাদ পদ্ধতির কারণে এখন বিঘায় ফলন ৪০ থেকে ৪৫ মণ। ভুট্টার চাহিদাও রয়েছে। মণপ্রতি দাম এক হাজার ২০০ টাকা থেকে এক হাজার ৩০০ টাকা।’ তিনি বলেন, ‘ভুট্টাক্ষেতে আমরা সার দেই, ¯েপ্র করি। আমার স্বামী ও আমি মিলেই চাষাবাদ করি।’
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের জামালপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মঞ্জুরুল কাদির বলেন, ‘চরের দুর্গম এলাকায় উন্নতমানের বীজ পৌঁছে দেওয়া একটা চ্যালেঞ্জ। বাজারজাতকরণও একটি বড় সমস্যা। সেটি ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠছি। নদীভাঙনের শিকার যারা তারা একেবারে নিঃস্ব হয়ে যায়। এদের ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস থাকে। ব্যাংক এদের ঋণও দেয় না।’ তিনি বলেন, ‘জামালপুরে প্রচুর ভুট্টা, বাদাম, মরিচ ও বিভিন্ন ধরনের সবজির চাষ হয়। দেওয়ানগঞ্জের চর এলাকার প্রধান ফসলই হলো ভুট্টা। এরপর মরিচ। এছাড়া বাদাম, কাউন হচ্ছে। চরে পেঁয়াজও হচ্ছে। আন্তঃফসলও হয়, একসঙ্গে বাদাম ও পেঁয়াজ চাষ হচ্ছে।’
দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আবুল হাসান রাজু জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেওয়ানগঞ্জে মোট আবাদি জমি ১৮ হাজার ৮৩৮ হেক্টর। ভুট্টা আমাদের দেওয়ানগঞ্জে অন্যতম একটা প্রধান ফসল এখন। এবার ৫ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল, কিন্তু লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হয়েছে এবার। ১০০ হেক্টর লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এবার ২২০ হেক্টর জমিতে বাদামের আবাদ হয়েছে। মরিচ আবাদ হয়েছে ৩৫০ হেক্টর জমিতে।’