মো: মঈন উদ্দিন রায়হান : আউল-বাউল-লালনের দেশে রক আর পপ সংগীতের আগ্রাসনে সাধের খঞ্জনি-দোতরা-সারিন্দা নিভৃতে কান্দে। এককালে জনপ্রিয় লোকজ এই বাদ্যযন্ত্রগুলো এখন বিলুপ্তপ্রায়। নতুন প্রজন্মের অনেকেই এসব যন্ত্র চেনেন না। তাদের কাছে যন্ত্রগুলো পরিচয় করিয়ে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে ময়মনসিংহে গড়ে উঠেছে হয়ে গেল লুপ্তপ্রায় বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের ব্যতিক্রমী এক জাদুঘর। এতে রয়েছে সতের থেকে উনিশ শতাব্দীর দুর্লভ বাদ্যযন্ত্র।

ময়মনসিংহ শহরের বড় বাজারে রয়েছে ‘নবাব এন্ড কোং’ নামে একটি বাদ্যযন্ত্রের দোকান। তিন পুরুষ ধরেই বাদ্যযন্ত্র ব্যবসার জড়িত একটি পরিবার। সেই পরিবারের ছেলে রেজাউল করিম আসলাম বংশপরম্পরায় বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে সংসার পেতেছেন। তার নেশা বিরল বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহের দিকে। সেই আগ্রহ থেকে নগরীর ঈদগাহ মাঠের বিপরীতে কাঁচিঝুলি রোডস্থ ব্যাপ্টিস্ট চার্চ গির্জার নিচতলায় গড়ে তুলেন ‘এশিয়ান মিউজিক মিউজিয়াম’।

রেজাউল করিম আসলামের দাদা নবাব আলী ১৯৪৪ সালে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসা শুরু করেন। পরে তার বাবা জালাল উদ্দিন ব্যবসার হাল ধরেন তিন পুরুষ ধরেই এই বাদ্যযন্ত্র ব্যবসার সাথে বংশ পরম্পরায় জড়িত আসলামের পরিবার।

রেজাউল করিম আসলাম মূলত একজন বাদ্যযন্ত্র ও লোকজ সংস্কৃতি সংগ্রাহক, তার সংগ্রহে রয়েছে লুপ্তপ্রায়, বিলুপ্ত ও চলমান ৬০০ বাদ্যযন্ত্র। আসলাম ২০০৬ সাল থেকে শুরু করেন বিরল বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ। সংগ্রহের পাশাপাশি রেজাউল করিম আসলাম এসব নিয়ে গবেষণাও করছেন।

রেজাউল করিম জানালেন, ঢেম্পারেঙ, বরতাল, চঙ, দভন্ডি, দোতারা, চিকারা, গিনটোঙ, ঘেরা, যোগী সারঙ্গী, হালগি, মুগরবন, পোহল, থিমিলা, শিঙ্গা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বর্তমানে অনেকটা দুর্লভ বাদ্যযন্ত্রে পরিণত হয়েছে।

ততযন্ত্র, আনদ্ধ যন্ত্র, শুষির যন্ত্র এবং ঘন যন্ত্রের চার প্রকারের প্রায় ১০০টি লুপ্ত, বিলুপ্তপ্রায় ও চলমান বাদ্যযন্ত্রের সংগ্রহ রয়েছে তার।

রেজাউল করিম বাদ্যযন্ত্র নিয়ে কিছুটা গবেষণাও করছেন। হারিয়ে যাচ্ছে যে যন্ত্রগুলো, আধুনিক কারিগরদের দিয়ে ওই যন্ত্রের আদলে নতুন করে আবার বাদ্যযন্ত্র তৈরি করছেন। বেশির ভাগ পুরোনোটার মতোই কাজ দিচ্ছে বলে তাঁর দাবি। বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি, রেডিও,রেকর্ড প্লেয়ার, গ্রামোফোন, এলপি রেকর্ড ও গানের বইসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য জিনিসও সংগ্রহে আছে তার।

media image
ছবি

আসলামের সংগৃহীত বাদ্যযন্ত্রগুলোর অন্যতম একতন্ত্রী বীণা (প্রচলিত নাম একতারা, বাউল, বৈরাগী ও ভিক্ষুকরা যন্ত্রটি বেশি ব্যবহার করেন), সেতার, সারেঙ্গী (পৌরাণিক কাহিনি, ধর্মীয় ও ভক্তিমূলক গানের সঙ্গে ব্যবহৃত হয়), এ¯্রাজ (উচ্চাঙ্গ একক যন্ত্র), সুর সংগ্রহ (প্রচলিত নাম স্বরাজ, লোকজ গানে ব্যবহার হয়), তম্বুরা (প্রচলিত নাম তানপুরা, গায়ক ও বাদকের সঙ্গীতচর্চায় ব্যবহার হয়), বেহালা, গোপীযন্ত্র (প্রচলিত নাম লাউয়া, বাউল, বৈরাগী ও ভিক্ষুক সম্প্রদায় বেশি ব্যবহার করে), ব্যাঞ্জো, সারিন্দা (প্রাচীন ও দেশীয় সঙ্গীতে ব্যবহৃত হয়), আনন্দ লহরি (প্রচলিত নাম গুবগুবিখমক, বাউল ও ভিক্ষুক সম্প্রদায় বেশি ব্যবহার করে), সুরবাহার (উচ্চাঙ্গে অনুগামী যন্ত্র), ম্যান্ডেলিন (আরবি সুর ও সঙ্গীতে ব্যবহৃত হয়), তুবড়ি (প্রচলিত নাম বীণ, গ্রাম্য গান ও সাপুড়িয়াদের সাপখেলায় ব্যবহার হয়), বাঁশি, শঙ্খ (পূজা, মাঙ্গলিক, প্রাত্যহিক অনুষ্ঠান ও সঙ্কেত জ্ঞাপনে ব্যবহার হয়), সানাই (উচ্চাঙ্গসঙ্গীত জলসায়, মাঙ্গলিক ও বিয়েতে ব্যবহার হয়), ক্ল্যারিওনেট (অর্কেস্ট্রা ও ব্যান্ডদলে ব্যবহার হয়), ট্রাম্পেট (অর্কেস্ট্রা ও ব্যান্ডদলে ব্যবহার হয়), হারমোনিয়াম (সবধরনের সঙ্গীতে ব্যবহার হয়), প্রেমজুড়ি (প্রচলিত নাম চটি, লোকজ ও ভক্তিমূলক সঙ্গীতে ব্যবহার হয়), নাকারা (রাজকীয় কাজ, খাজনা আদায় ও লাঠিখেলায় ব্যবহার হয়), ঢোলক (যাত্রা, থিয়েটার ও ঐকতানে ব্যবহার হয়), ডমরু (প্রচলিত নাম ডুগডুগি, ভালুক, বানর ও সাপখেলায় ব্যবহার হয়), খঞ্জরি (প্রচলিত নাম হাতবায়া, লোকজ ও ভক্তিমূলক সঙ্গীতে ব্যবহার হয়), মৃদঙ্গ (প্রচলিত নাম খোল, কীর্তনসঙ্গীতে ও মনিপুরী নৃত্যে ব্যবহার হয়), তবলা ও বায়া, ঢোল (কবি ও বাউল গানে ব্যবহার হয়), ঝাঁঝর (প্রচলিত নাম ঝাঁঝ, ঐকতান ও রণসঙ্গীতে ব্যবহার হয়), ঘণ্টা (দেবপূজায় ব্যবহার হয়), খঞ্জনি (প্রচলিত নাম মন্দিরা, মাঙ্গলিক ও রবীন্দ্রসঙ্গীতে ব্যবহার হয়), খরতাল (ঐকতান ও ভজনগীতে ব্যবহার হয়), ঘড়ি, কৃষ্ণকাঠি (প্রচলিত নাম চটি, লোকজ ও ভক্তিমূলক সঙ্গীতে ব্যবহার হয়), মেকুড় (প্রচলিত নাম মেহুর, জারিগান ও পালাগানে ব্যবহার হয়), নূপুর, সেকাস (পারকারসনে ব্যবহার হয়), পাখোয়াজ (লহর ও নৃত্যে একক যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার হয়) ও শারদ (উচ্চাঙ্গ ও একক যন্ত্র হিসেবে বেশি পরিচিত)।

আসলাম জানান, কারও গবেষণায় বা কারও শেখার আগ্রহে কাজে লাগছে যন্ত্রগুলো। মানুষ জানতে পারছে ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তিনি আরো বলেন, বাদ্যযন্ত্র তৈরি কারক, বাদক, উপকরণ সবই হারিয়ে যাচ্ছে। এগুলো হারানোর বা নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এই উদ্যোগ।

উল্লেখ্য, সংগৃহীত যন্ত্রগুলো নিয়ে রেজাউল করিম আসলাম প্রথম প্রদর্শনী করেন ২০০৩ সালে ময়মনসিংহ লোকজ মেলায়। ২০০৪ সালে প্রদর্শনী করেন জয়নুল সংগ্রহশালায়।

২০০৬ সালে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে ঢাকার বৈশাখী উৎসবেও আসলাম যন্ত্রগুলো প্রদর্শন করেন। এরপর ২০০৮ সালে জয়নুল উৎসব, ২০১২ সালে মোতাহার হোসেন বাচ্চুর জন্মবার্ষিকী, ২০১২ সালে হালুয়াঘাটে প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহে, ২০১৬ সালে ঢাকায় বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব, ২০১৭ সালে সিলেটে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের লোকজ উৎসব, ২০১৮ সালে জাতীয় জাদুঘরের ২৮নং গ্যালারিতে বাদ্যযন্ত্র প্রদানসহ গ্যালারী সজ্জিত করেন কাজ করেন তিনি এবং সর্বশেষ ২০২২ সালে ময়মনসিংহে সতেরো শতাব্দী থেকে উনিশ শতাব্দীর ১২টি দুর্লভ সারিন্দা নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করেন।

এছাড়াও আসলাম প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। নাম ‘নোভিস ফাউন্ডেশন’। নোভিস আর্টিস্টিক এডুকেশন সেন্টার নামে একটি শিক্ষালয়ও পরিচালনা করেন তিনি। উপমহাদেশীয় ও পাশ্চাত্য রীতির সমন্বয়ে সঙ্গীত, নৃত্য, চারুকলা, গিটার, বেহালা ও দোতারা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এখানে। আসলাম স্বপ্ন দেখেন বাদ্যযন্ত্রের জাদুঘরটি আরো বৃহৎ আকারে করার।