মেহেদী হাসান আকন্দ: মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহ করে মাসে লক্ষাধিক টাকাআয় করছেন মৌচাষি শাহ আলম।শাহ আলমনেত্রকোণার বারহাট্টা উপজেলার মধুপুর গ্রামের রমজান আলীর ছেলে। শাহ আলম নারায়নগঞ্জের একটি প্রিন্টিং কোম্পানীতে চাকরি করতেন।
বিশ^ব্যাপী করোনা মহামারীর সময় কোম্পানী বন্ধ হলে চাকরি হারিয়ে বিসিক থেকে তিনি মৌমাছি পালনের ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
বিসিক নেত্রকোণা জেলা কার্যালয়ের উপ-ব্যবস্থাপক আকরাম হোসেনের পরামর্শে ২০২০ সালে ৫টি বাক্স দিয়ে তিনি শুরু করেনমৌমাছিরখামার।শাহ আলমের খামারে এখন ১৩০ টি মৌমাছির বাক্স। মৌমাছির খামার নিয়ে তিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহ করেন।
মৌমাছি খামারের মালিক শাহ আলম জানান, ২০২০ সালে মাত্র ৫০ হাজার টাকা পুজি নিয়ে ৫ টি বাক্স দিয়ে তিনি মৌমাছি চাষ শুরু করেন। বর্তমানে ১৩০ টি মৌমাছির বাক্স রয়েছে। মৌমাছির এই খামার নিয়ে তিনি বছরে ৬মাস দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহ করেন।
শাহ আলম জানান, প্রতিটি বাক্সে ৯-১০টি কৃত্রিম মমের সিড দেয়া হয়। সেই সিডে মৌমাছিরা মধু জমা করে। প্রতিটি বাক্সে একটি রানী মৌমাছি থাকে। রানী মৌমাছি প্রায় ২ থেকে ৩ বছর বেঁচে থাকে। পুরুষ মৌমাছি মিলনের পর মৃত ঘটে। তবে শ্রমিক মৌমাছির গড় আয়ু ৯০ দিন। একটি রানী মৌমাছি প্রতিদিন ১ হাজার থেকে ১৪’শ ডিম দেয়। ডিম দেয়ার ১৩-১৪ দিনেই রানী মৌমাছির জন্ম হয়, ১৭-১৮ দিনে পুরুষ মৌমাছির জন্ম হয় এবং ২১দিন পর শ্রমিক মৌমাছির জন্ম হয়। মৌমাছির জন্মের ৬দিন পর থেকে মধু সংগ্রহ শুরু করে।
তিনি বলেন, নভেম্বর মাস থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহের সময়। এময় বিভিন্ন ধরনের ফুল ফোটে। নভেম্বর মাসে কলমাকান্দার সীমান্তবর্তী মেঘালয়ের পাদদেশে পাঁচগাও এলাকা অথবা শেরপুর জেলার পাহাড়ি এলাকায় তিনি মৌমাছির খামার স্থাপন করেন। ডিসেম্বর ও জানুয়ারী মাসে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে সরিষা ফুলের সমারোহ থাকে। এসময় তিনি খামারটি কলমাকান্দা অথবা টাঙ্গাইলে স্থানান্তরিত করেন। ফেব্রুয়ারী মাসে গোপালগঞ্জের বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে ধনিয়া ও কালোজিরার ফুল ফোটে। এসময় তিনি খামারটি গোপালগঞ্জে স্থানান্তরিত করেন। মার্চ মাসে গাছে গাছে লিচু ফুলের সমারোহ থাকে। এসময় তিনি দিনাজপুর অথবা গাজীপুর খামারটি স্থানান্তরিত করেন। এরপর এপ্রিল মাস জুড়ে সুন্দরবন অথবা শেরপুরের পাহাড়ি এলাকায় খামারটি স্থাপন করে মধু সংগ্রহ করেন।
প্রতিবাক্স থেকে মাসে কমপক্ষে ১২ কেজি করে ৩ বার মধু সংগ্রহ করা হয়। খামারটি থেকে প্রতিমাসে কমপক্ষে পনের’শ কেজি মধু সংগ্রহ করা হয়। যারবর্তমান পাইকারি বাজার মূল্য প্রায় ৬ লক্ষাধিক টাকা। ৬মাসে প্রায় ৩৬ লক্ষ টাকার মধু বিক্রি করেন বলে তিনিজানান।বাকি ৬ মাস ফুলের পরিমাণ কম থাকায় প্রতিটি বাক্সে মৌমাছির খাবারের জন্য গড়ে ১০কেজি করে চিনি সরবরাহ করতে হয়। ৬মাসে প্রায় ৮ হাজার কেজি চিনি মৌমাছির জীবিকার জন্য সরবরাহ করতে হয়। যার বাজার মূল্য প্রায় ৯ লক্ষ টাকা। মৌমাছির খামারে সারা বছর নিয়মিতভাবে ৩ জন শ্রমিক কাজ করেন। শ্রমিকের বেতন, পরিবহণ খরচ ও আনুসঙ্গিক খরচ বাদে গড়ে প্রতিমাসে লক্ষাধিক টাকা আয় করছেন শাহ আলম।
মৌচাষি শাহ আলম বলেন, লেখাপড়া শিখে চাকরি না পেয়ে অনেকেই হতাশায় ভূগছেন।
বিসিক নেত্রকোণা জেলা কার্যালয়ে উপব্যবস্থাপক মো. আক্রাম হোসেন স্যারের পরামর্শ নিয়ে কেউ উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী হলে তাকে সব ধরনের সহযোগিতা তিনি করবেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নেত্রকোণা কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহাম্মদ নুরুজ্জামান বলেন, মৌমাছির খামার সরিষা, ধনিয়া ও কালাজিরা খেতের পাশে স্থাপন করায় মৌমাছির মাধ্যমে ফুলের পরাগায়নে সহায়তা হচ্ছে। ফলে একদিকে উৎপাদন বাড়ছে, অপরদিকে মধু আহরণ করা যাচ্ছে। মৌমাছির খামার খেতের পাশে স্থাপনে কৃষকরা ও মৌচাষি উভয়ই লাভবান হচ্ছেন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) নেত্রকোণা জেলা কার্যালয়ে উপব্যবস্থাপক মো. আক্রাম হোসেন বলেন, জেলার বেকার যুবসমাজের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে নিয়মিতভাবে শিল্প উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।শিল্প উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্যে আগ্রহীদের নিয়মিত তদারকি ও সরকারি আর্থিক ঋণ সহায়তা প্রদান করার ফলে নেত্রকোণায় বহু উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। মৌচাষি শাহ আলম একজন ভালো উদ্যোক্তা।
তিনি বিসিক কার্যালয় থেকে মৌচাষের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে প্রশিক্ষণলব্দ জ্ঞান বাস্তবে কাজে লাগিয়ে এখন মাসে লক্ষাধিক টাকা রোজগার করছেন। পাশাপাশি তিনি তিনজন লোকের কর্মসংস্থান করতে পেরেছেন। শাহ আলমের সফলতা সরেজমিনে দেখে কেউ আত্মকর্মসংস্থানে আগ্রহী হলে উদ্যোক্তা তৈরিতে বিসিক নেত্রকোণা কার্যালয়ের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করবেন বলে তিনি জানান।