স্টাফ রিপোর্টার : আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ময়মনসিংহে ১১ টি আসনের মাঝে অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসন। এই আসনে বিগত দুই মেয়াদে এমপি ছিল রওশন এরশাদ। এবার নির্বাচনের মাঠে রওশন এরশাদ না থাকলেও বিভাগীয় সদর হওয়ায় এই আসনটি অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ আসন।

এই আসনে নির্বাচন করছে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মোহিত উর রহমান শান্ত ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ও সাবেক প্রয়াত ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের পুত্র। ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আমিনুল হক শামীম জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহসভাপতি ও ময়মনসিংহ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি এবং ময়মনসিংহ জেলা মোটর মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি।

এই আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে ট্রাক প্রতীকের আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর। ভোটাররা বলছেন, নির্বাচনে বিএনপি নেই এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী যিনি হয়েছেন তিনি তো আওয়ামী লীগেরই লোক। শেখ হাসিনার অনুমতি নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছে। তাই নৌকা ও ট্রাকের মধ্যে হবে ভোটের তীব্র লড়াই। সাধারণ ভোটাররা আরও বলেন, যদি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট হয় তাহলে নৌকার বিপরীতে অন্যান্য প্রার্থীর তুলনায় ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থীই এগিয়ে থাকতে পারে।

এছাড়াও কাঁচি প্রতীক নিয়ে নির্বাচনী মাঠে আছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপির সাবেক এমপি ও ময়মনসিংহ পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন খান দুলু, লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী আবু মুসা সরকার, তরিকত ফেডারেশনের ফুলের মালা প্রতীকের প্রার্থী বিশ্বজিত ভাদুরী, বাংলাদেশ কংগ্রেসের ডাব প্রতীকে আব্দুল মান্নান, তৃণমূল বিএনপির সোনালী আশ প্রতীকের দীপক চন্দ্র গুপ্ত, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের গামছা প্রতীকে পরেশ চন্দ্র মোদক, ন্যশনাল পিপলস পার্টির আম প্রতীকে মো: হামিদুল ইসলাম, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির একতারা প্রতীকে সেলিম খান।

ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ৩৩টি ওয়ার্ড ও ১১টি ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ে ময়মনসিংহ-৪ সদর আসন গঠিত। এই আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৬ লক্ষ ৫০ হাজার ২৮৪ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ৩ লক্ষ ২২ হাজার ৭৯৭ জন এবং নারী ভোটার ৩ লক্ষ ২৭ হাজার ৪৭৭ জন। জেলার মর্যাদাপূর্ণ এই আসনে যে দল থেকে এমপি নির্বাচিত হন সেই দলই সরকার গঠন করে বলে একটি বিশ্বাস চালু আছে। এক সময় ময়মনসিংহ সদর আসনকে এন্টি আওয়ামী লীগের আসন বলে বিবেচনা করা হলেও এখন আর এই অবস্থা নেই। নতুন প্রজন্মের তরুণ ভোটাররাই এখন এই বদলে দেওয়ার মূল নিয়ামক শক্তি বলে মনে করা হচ্ছে। এই আসনে প্রধান ৩ দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির থেকে ৩ বার করে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। ভোটের হিসেবে এই আসনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি বলা যায় সমান শক্তিধর।

এই আসনে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির একেএম ফজলুল হক, ১৯৯৬ জাতীয় পার্টির বেগম রওশন এরশাদ, ২০০১ সালে বিএনপির দেলোয়ার হোসেন খান দুলু, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের অধ্যক্ষ মতিউর রহমান এবং গত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এ আসন মহাজোটকে ছাড় দেওয়ায় জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ এমপি হন।

এদিকে, টানা ৩ মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় দেশব্যাপী যে উন্নয়ন হয়েছে সে তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে ময়মনসিংহ। উন্নয়নে পিছিয়ে পড়ার জন্য যোগ্য নেতৃত্বের অভাবকেই মনে করছেন স্থানীয়রা। যোগাযোগ ব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ ভৌত অবকাঠামো ছাড়া দৃশ্যমান তেমন উন্নয়ন হয়নি ময়মনসিংহ সদরে। যদিও ময়মনসিংহ-৪ সদর আসনে জাতীয় পার্টির এমপি রওশন এরশাদের উদ্যোগে ময়মনসিংহ পৌরসভা থেকে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন ও ময়মনসিংহ জেলা থেকে ময়মনসিংহ বিভাগ হয়েছে। ময়মনসিংহের পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদ খননের কাজ চলছে।

ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর নগরীর কেওয়াটখালি এলাকায় দেশে প্রথম স্টিল আর্চওয়ে সেতু ও নগরীর রহমতপুর বাইপাসে ব্রহ্মপুত্রের ওপর আরেকটি সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি ময়মনসিংহবাসীর প্রত্যাশিত ঢাকা-ময়মনসিংহ রেললাইনে দুই জোড়া আন্তঃনগর ট্রেন চালু ও ঢাকা-ময়মনসিংহে ডাবল রেললাইন স্থাপন, আরেকটি পরিকল্পিত নগর গড়ে তোলা, নগরীর ভেতরে থাকা রেললাইনের কারণে সৃষ্ট যানজট নিরসনে পরিকল্পিত ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ, সদরে আলাদা জেনারেল হাসপাতাল নির্মাণ যাকে দিয়ে সম্ভব সেই প্রার্থীকেই এবারের নির্বাচনে বেছে নিতে চান এই আসনের ভোটাররা।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রতীক বরাদ্দের পর থেকেই এই আসনে জমে উঠেছে প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচার। আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত নেতাকর্মী ও সমর্থকসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষের নৌকার প্রার্থীর প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিলেও আওয়ামী লীগের একাংশ প্রকাশ্যে মোহিত উর রহমান শান্ত পক্ষে প্রচারে নামেননি। যারা প্রকাশ্যে নৌকার পক্ষে প্রচারে নেমেছেন তাদের কেউ কেউ তলে তলে সমর্থন দিচ্ছেন ট্রাক প্রতীকের আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী আমিনুল হক শামীমকে। নৌকার সমর্থকরা বলছেন গণসংযোগে ব্যাপক সাড়া মিলছে। ময়মনসিংহের উন্নয়নে ভোটাররা শেখ হাসিনা মনোনীত নৌকার প্রার্থীকেই বেছে নেবে এবারের নির্বাচনে।

অপরদিকে, ময়মনসিংহ সিটি মেয়র ও ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকরামুল হক টিটুর সহোদর বড় ভাই আমিনুল হক শামীম নৌকা প্রতীক না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে নেমেছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগে প্রভাবশালী এই স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গেও আছেন অনেকে। ময়মনসিংহ সিটি সাবেক ও বর্তমান অনেক কাউন্সিলর, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক ও বর্তমান অনেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের সাবেক ও বর্তমান চেয়ারম্যান। এর বাইরে নারী উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী সমাজ ও পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষের একটি অংশ সমর্থন দিচ্ছেন এই স্বতন্ত্র প্রার্থীকে। ইতোমধ্যে এই প্রার্থী মাঠঘাট চষে বেড়ানো সমর্থকদের দাবি ময়মনসিংহের উন্নয়নে আমিনুল হক শামীমের (সিআইপি’র) বিকল্প নেই।

নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মোহিত উর রহমান শান্ত বলেন, আওয়ামী লীগের একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে বাবা সাবেক ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের নীতি নৈতিকতা ও আদর্শের পথ ধরেই দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে যা দরকার সবকিছুই করছি। বাবার পথ ধরেই হাটছি। করোনাকালীন দলের কর্মী সমর্থকসহ স্থানীয় এলাকাবাসীকে নানাভাবে সহায়তা দিয়ে পাশে থেকেছি। বাবা মন্ত্রী থাকাকালীন অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি। মানুষকে সহায়তা করেছি। দলের দুর্দিনে নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রাম ও কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছি। সিটি ও প্রতিটি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে পারিবারিক ও রাজনৈতিকভাবে আত্মিক সুসম্পর্ক রয়েছে আমার। নৌকা পাগল ময়মনসিংহ সদরের মানুষ একজন পরীক্ষিত কর্মী হিসেবে এই আসনে আমার বিজয় নিশ্চিত করবে। জাতীয় পার্টির রওশন এরশাদকে ছাড় দেওয়ায় গত ১০ বছর এই আসনের ভোটার নৌকায় ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়নি। এজন্য এ আসনের ভোটার নৌকায় ভোট দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে বলে জানান তিনি।

মোহিত উর রহমান শান্ত আরো বলেন, নির্বাচিত হলে ময়মনসিংহ সদরকে সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত করার পাশাপাশি উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখবেন।

আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী আমিনুল হক শামীম জানান, আওয়ামী লীগের প্রতিটি কর্মসূচি বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছি। দলের জন্য সবসময় সাধ্যমতো সময় দিয়েছি। করোনার সময় নানা সহায়তা দিয়ে দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষের পাশে থেকেছি। দলের নেতাকর্মী ও সমর্থক ছাড়া নানা শ্রেণি পেশার মানুষ যখনই কোনো কাজে আমার কাছে এসেছে, আমি তাদের সাধ্যমতো সহায়তা করার চেষ্টা করেছি। ময়মনসিংহ সদরের মানুষ সব সময় আমাকে কাছে ও পাশে পেয়েছে। আশা করি স্থানীয় ভোটাররা আমার কর্মকান্ডের মূল্যায়ন করবেন।

তিনি আরো বলেন, আমি নির্বাচিত হলে চরাঞ্চলের উৎপাদিত কৃষি পণ্যের সংরক্ষণে ব্যবস্থাসহ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ময়মনসিংহ-৪ সদর আসনের চেহারা পাল্টে দিতে সক্ষম হবো। মাদক ও সন্ত্রাস নির্মূলেও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করব।

স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপির সাবেক এমপি ও ময়মনসিংহ পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন খান দুলু জানান, পৌরসভার চেয়ারম্যান ও এমপি থাকাকালে নানা শ্রেণি পেশার মানুষের আপনজন ও আস্থার প্রতীক হয়ে কাজ করেছি। ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, পরানগঞ্জে ২০ শয্যার হাসপাতাল, ময়মনসিংহ বাইপাস সড়ক নির্মাণ, চরাঞ্চলে ভেড়িবাঁধ নির্মাণ, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উন্নয়ন, ময়মনসিংহে মা ও শিশু কল্যাণ হাসপাতাল স্থাপনসহ অনেক উন্নয়ন কাজ করেছে। মানুষ এসব উন্নয়নের সুফল পাচ্ছে এখন। আসন্ন নির্বাচনে ময়মনসিংহ সদরের মানুষ আমার কর্মকান্ডের মূল্যায়ন করবে বলে তিনি আশা করছেন। তিনি আরও বলেন, রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের কারণে বিএনপি থেকে দূরে থাকলেও এলাকাবাসীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ট ও আত্মিক যোগাযোগ রয়েছে। দলে পদ পদবি না থাকলেও জনগণের কাতারে থেকে মানুষের সেবা করতে চাই।

জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী আবু মুসা সরকার জানান, ময়মনসিংহ সদর আসনে জাতীয় পার্টির ভোট ব্যাংক রয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে না আসায় এবং আওয়ামী লীগের ভোট ভাগাভাগি ভাগ্যদুয়ার খুলে দিতে পারে বলে জানান এই প্রার্থী। সংসদ নির্বাচনে নতুন মুখ হলেও প্রচারে ব্যাপক সাড়া দেখে জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী হয়ে উঠেছেন তিনি।

ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল জানান, নির্বাচনকে উৎসবমুখর ও ভোট কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতেই আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা আসন্ন নির্বাচনে দলের জনপ্রিয় প্রার্থীকেই বেছে নেবে।

এসবের বাইরে অন্যান্য দলের প্রার্থীরা নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে প্রতিদিন মাইকিংসহ নানা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।