লিয়াকত আলী লাকী।
বাংলা নাট্যমঞ্চের একজন ব্যক্তির নাম। আবার বহুজন মানুষের মধ্যখান থেকে একক একজনের নাম। নাটক নিয়ে তিনি ঘুরেছেন নানান্ দেশ। সে জায়গাগুলোতে বাংলাদেশের বাংলা নাটককে তিনি উদ্ভাসিত করেছেন। পরিচিত করেছেন বাংলা নাটক আর নাটকের আঁতূড়ঘর।
পদ্মা মেঘনা যমুনা বুড়িগঙ্গা আড়িয়ালখা আর ব্রহ্মপুত্রের স্রোতস্বিনীর কিনার ঘেঁসেঘেঁসে। তিনি যেখান দিয়েই নৌকার গূণ টেনে গেছেন সেখনেই এঁকে দিয়েছেন নাট্যমঞ্চের বাতিঘর।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের প্রথম লগনে বাংলাদেশের নাট্যমোদী গুণগ্রাহীরা তাকে দেখতে পান সাংস্কৃতিক বিভিন্ন আন্দোলনে। সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তিনি রাজপথ কাঁপানোর সক্ষমতা রাখতেন। আমার জানামতে স্বৈরাচারবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোকে তিনি সাংস্কৃতিক আবহে টালমাটাল করে রাখতেন। আন্দোলনের মাসকে মাস তার পরিচালনায় দর্শকশ্রোতা তন্ময় হয়ে দেখতেন কিন্তু তাদের মাঝে গান নাটক আর ক্যারিকেচার সম্বলিত পালানাটক সেইসময়ে দর্শকদের মাঝে ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া ধাবমান থাকতো। খোলা আকাশের নীচে রাজপথের সুবিধাজনক স্হানে নাটক আর গান বাজনার মধ্য দিয়ে এমনতরো ক্যারিশম্যাটিক উপাদান যেমন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীশক্তিগুলোর কম্পন তীব্রভাবে বাড়িয়ে তুলে তেমনই লিয়াকত আলী লাকীর প্রতি জনমানুষের ভালোবাসা বাড়িয়ে দিয়ে উচ্চমাত্রায় নিয়ে যায়। লিয়াকত আলী লাকী তখন বুঝে গিয়েছেন নাটকের মাধ্যমে সঙ্গীতের কৌশল বাড়িয়ে দিয়ে গণজাগরণকে উচ্ছ্বসিত করা সম্ভব। রাজনীতি আর সুস্হ সংস্কৃতি যে ওতোপ্রোতো ভাবে সংবেদনশীল আর পরিচ্ছন্ন ভাবে জড়িত এটাও দেখিয়ে দিয়েছেন সর্বজনপ্রিয় লিয়াকত আলী লাকী।
ঢাকা থাকাকালীন সময় লিয়াকত আলী লাকীর নাম বহুবার বহুমানুষের কাছে শুনেছি। দূরথেকেও দেখেছি। আমার ঢাকার বন্ধুদের সাথেও তাকে দেখেছি। কিন্তু ওই সময় আর কাছাকাছি অবস্হানে যাইনি। শেষ দেখা হয়েছিলো ময়মনসিংহে আমাদের গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের প্রথম সম্মেলনে। তিনি তখন সবে ব্যংকক থেকে ঢাকা এসেছেন এবং পরপরই ময়মনসিংহে আসলেন।
মজার কথা হলো তিনি যখন৷ সাংস্কৃতিক আন্দোলন জোরদার করে ঢাকার রাজপথে প্রচন্ড ঝাকুনি আর কাপুনি দিয়ে যাচ্ছেন সেই সময়টাতেই আমরা বাংলাদেশের নাটকে সেন্সরশীপের বিরুদ্ধে ময়মনসিংহের রাজপথে মিটিং মিছিল আর সমাবেশ করে যাচ্ছি সেই সাথে একের পর এক দর্শণীর বিনিময়ে নাটক দেখার জন্য সুধিসমাজকে উদ্ভুদ্ধ করে যাচ্ছি । আমাদের অগ্রজ নাট্যমঞ্চের কর্ণধার শাহাদাত হোসেন খান হীলু হেলাল উল ইসলাম ইকবাল আহমদ শাহজাহান মাহমুদ মণি ভট্টাচার্য আমি নিজাম মল্লিক নিজু হাসান রাজা দীলিপ দে অরুণ ভট্টাচার্য নয়ন সইম আশরাফুল আলম নুরুল ইসলাম মজনু রাজীব পন্ডিত নান্টু কাজী ছোটন তৌহিদ হাসান কিবরিয়া ওয়াহাব মাহমুদ রমজান ( এই মুহূর্তে অনেকেরই নাম মনে পড়ছেনা ) সে সময় লেখাপড়ার বাইরে নাটকই ছিলো আমাদের একমাত্র আরাধনা সেই সাথে ছিলো শিষ্টাচার। তখন ময়মনসিংহ টাউন হল নাট্যমঞ্চের বাতি নিভতো না ।
বাহূল্যতা নয় যে সেই সময় লিয়াকত আলী লাকীর খ্যাতনামা নাট্যদল পিপলস থিয়েটার আর আমরা হয়তো বা একই গোত্রভুক্ত ছিলাম।
আজ আমরা নাটক নামের যে প্ল্যাকার্ডটি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি তাতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে। এর মধ্যে হানা দেয় রোগ শোক জ্বরা সহ নানাবিধ ব্যাধি। পাঁচ পা এগিয়ে গেলে তিন পা পিছিয়ে পড়তে হয়।
দুই থেকে আড়াই বছর অকাতরে পড়ে রইলাম অজানা মৃত্যুব্যাধি সর্বনাশা করোনা ভাইরাসে। কিন্তু আজ ভাবতেও ভালো লাগে মহান আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন। অনেক নিকটজন বন্ধুবান্ধবদের হারিয়েও ---
আজ এক্ষনে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের চেয়ারম্যান বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক নাট্যপ্রাণ শ্রদ্ধাভাজনেষু লিয়াকত আলী লাকীর কথা এবং সৃজনশীল কর্মের কথাই বারবারই মনে পড়ছে এই ভেবে যে - করোনা চলমানে সবাই প্রত্যক্ষ করেছেন হয়তো করোনার সময় থাকতেই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আর্তপীড়িত লোকজনের সেবাপ্রদানে বিশেষকরে নাটকের লোকজনের দুরাবস্থার সমাধান করার জন্য অল্প অল্প করে হলেও খাদ্য শুকনোখাবার পর্যাপ্ত মাস্ক নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য আহারসামগ্রী ইত্যাদির জন্য কেউ যেনো দূর্ভোগে না পড়েন সেজন্যে তার অবিরাম প্রচেষ্টা মানুষজনকে তো বলতেই হবে।
একটা প্রবাদ আছে -
বিনা যুদ্ধে নাহি দিবো সূচাগ্র বেদীনি। লিয়াকত আলী লাকী এই রকমই মানুষ।
এক সময় মিনমিন করে অবিশ্বাস্য করোনা ভাইরাসের সমাপ্তি ঘটলেও নাট্যলোক হয়ে গেলো নিরব নিস্তব্ধ। কেউ আসেনা নাটকের ধারেকাছে। বুঝতে পারা যায় নাটকে তারা ফিরতে চায় কিন্তু অজানা আশংকায় দূরোদূরো বক্ষ কম্পমান হয়ে উঠে।
আবারও এলেন দৃঢ় অঙ্গিকার নিয়ে সূচাগ্র বেদীনি হাতে লিয়াকত আলী লাকী। তার ভয় নেই। ভয় থাকার কথাও নয়। তিনি তো অর্জূণ।
দুর্ধষ্য প্রাণঘাতী করোনা মহামারী শেষ। কিন্তু রিহার্সালে শিল্পী আসেনা। কেমন যেনো ভয়ভয় কাজ করে তাদের জলে স্হলে অন্তরীক্ষে। আগের অবস্থানেই খা খা করতে লাগলো নাট্যমঞ্চ।
তবে লিয়াকত আলী লাকী ইউ টার্ণে গেলেননা। তিনি ফার্স্ট ফরোয়ার্ডের মানুষ।
একটার পর একটা টার্মকার্ড ছাড়তে লাগলেন। প্রথম ছাড়লেন-----
আর্ট এগেইনষ্ট করোনা। করোনা পরবর্তী শিল্পীত নাটক।
দ্বিতীয় ছাড়লেন ---
পথ নাট্য উৎসব। এপর্যায়ে সকল শিল্পকলা একাডেমি মঞ্চ ফ্রি করে দেয়া হল।
তৃতীয় ছাড়লেন -
২০ মিনিটের সময়সীমা পর্যন্ত নাটক। বলাবাহূল্য শুরু হলো লিয়াকত আলী লাকীর ভাবনায় নাটক মঞ্চায়ন।
চতুর্থ ছাড়লেন --
দশ মিনিটের লিয়াকত আলী লাকীর ভাবনার নাটক।
পঞ্চম টার্ম কার্ডটি ছাড়লেন --
৬৮ টি জেলায় নাটকের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শতবর্ষ নাটক উদযাপন। পাঠক এখানে লক্ষ্যনীয় ধীরেধীরে পিঁপড়ের সারির মতো দর্শক কিন্তু আসতে শুরু করলেন। কী বস্তীতে কি আবাসন এলাকায় কি রেললাইনের ধারে খোলা মাঠ স্কুল কলেজ কোন স্হানই বাদ গেলোনা।
ষষ্ঠ টার্মকার্ড হলো --
গণ জাগরনের নাট্য উৎসব।
এছাড়াও এক্রোবেট প্রদশর্শী চলচ্চিত্র প্রদর্শনী নৃত্য সংগীত সেই সাথে শতবর্ষের বন্দি হয়ে থাকা বাংলার ঐতিহ্যধারণকারি নাটক মঞ্চায়ন।
একজন নাটকের মানুষ লিয়াকত আলী লাকী। তার মস্তিষ্কে নাটক সম্বন্বিয় এতো যে উপমা উদাহরণ ভাবনা চিন্তা থাকতে পারে এর চাইতে প্রকৃষ্ট প্রমাণ কোথায় থাকতে পারে ? যিনি নাকি একটি বিরাণ ভূমিতে নাট্যফুল ফুটিয়ে দেখিয়ে দিলেন আপনারা সবাই দলমত নির্বিশেষে নাট্যফুলের নির্যাসটি গ্রহন করুন। দুঃসহ করোনা থেকে উঠে এসে আবার যখন মঞ্চ ভরে উঠেছে ফুলে ফুলে তখন নাটকের জয় হবেই।
------------------------------------------------------------------
নিজাম মল্লিক নিজু
সচিব প্রধান
সারেং থিয়েটার, ময়মনসিংহ।
১৯ মাঘ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ০২ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ, শুক্রবার
০১৭৩৬২২১৮৪৪