বিশেষ প্রতিনিধি : ভারতের মেঘালয়রাজ্য সীমান্তঘেষা শেরপুর জেলায়গারো, বর্মন, কোচ, হাজং, হদি, বানাই, ডালুসহ সাতটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস। এদের রয়েছে নিজস্ব মাতৃভাষা। এসব পরিবারের সুখ-দুঃখের গল্পটা চলে মাতৃভাষাতেই। তবে বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে পরিবাওে চর্চা কমে যাওয়া এবং নিজস্ব ভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ না থাকায় তারা তাদের ভাষাকে হারিয়ে ফেলছে। তাই তারা ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র রক্ষায় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, পাঠ্যবই এবং শিক্ষক দরকার বলে দাবি করছেন দীর্ঘদিন। প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় নিজস্ব বর্ণপরিচয়, চর্চা ও লেখাপড়ার সুযোগ না থাকায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নেতারা। কেবল মাত্র গারো জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষার বর্ণমালা বা প্রাক প্রাথমিকের বই ছাপার কাজ চলমান থাকলেও শিক্ষক না থাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বইগুলো কাজে আসবে না। ফলে শিকড় থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে এসব জাতি গোষ্ঠীর উত্তরসূরিরা।

শেরপুরের বেসরকারি সংস্থা হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডারস ফোরাম (এইচআরডি) এর সর্বশেষ তথ্য মতে, জেলায় গারো ২৬ হাজার, বর্মন ২২ হাজার, কোচ ৪ হাজার, হাজং ৩ হাজার, হদি ৩ হাজার ৫০০, ডালু ১ হাজার ৫০০, বানাই ১৫০ জন রয়েছেন। এদের অস্তিত্ব থাকলেও ভাষা হারিয়ে ফেলছে চারটি সম্প্রদায়ে মানুষ। তাই সম্প্রতি এইচআরডি এর পক্ষ থেকে গারো-কোচসহ অন্যান্য ভাষা টিকিয়ে রাখতে নানা সেমিনার ও মতবিনিময় করে যাচ্ছে। গারো, কোচ ও হাজং ভাষা কোনোমতে টিকে থাকলেও অন্য ভাষা প্রায় বিলুপ্তির পথে। ইতিমধ্যে সাতটি জনগোষ্ঠীর চার সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন তাদেও ভাষা বলতে পারে। কিন্তু তাদের পরবর্তী প্রজন্ম এ ভাষা বলতে শিখেনি। তাই আশঙ্কা করা হচ্ছে আগামীতে ওই সব সম্প্রদায়ের মানুষের ভাষা একেবারেই হারিয়ে যাবে।

জানাযায়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য নিজস্ব ভাষায় বই প্রকাশে ২০১০ সালে আইন প্রণীত হয়। সে মোতাবেক প্রাথমিক ও গণ শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের জন্য ছয়টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ভাষায় বই প্রণয়ন করে।

সেগুলোহলোচাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতাল ও সাদ্রি ভাষা। তবে এসব ভাষার বই পড়ানোর জন্য শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়নি বিদ্যালয়গুলোতে। তবে আজ পর্যন্ত গাড়ো ভাষার বই শেরপুরে পৌঁছায়নি। ফলে গারো সম্প্রদায়ের মানুষ হতাশা প্রকাশ করেছেন। শিক্ষার্থীরাও তাদের নিজস্ব মাতৃভাষার বর্ণমালা না থাকায় তাদের ভাষা হারানোর আশঙ্কায় রয়েছে।

বনকুড়াউচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিরণ চন্দ্র বর্মম বলেন, শিক্ষার্থীদেও পাশাপাশি আদিবাসী অভিভাবকরাও বাড়িতে তাদেও মাতৃভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে সর্বস্তওে বাংলা ভাষা ব্যবহারের কারণে। আবার অনেকেই সমাজে তাদের ভাষা প্রয়োগের বিষয়ে লজ্জাবোধ করে থাকেন।

ঝিনাইগাতী উপজেলার সাংবাদিক ও উন্নয়ন কর্মি কেয়ানকরেক বলেন, প্রত্যেক দেশের আলাদা আলাদা ভাষা থাকে থাকে আলাদা বৈচিত্র। এই বৈচিত্র টিকিয়ে না রাখলে আমাদের ঐতিয্য বিলুপ্ত হবে। তাই ভাষার মাসে আমাদের গাড়ো পাহাড়ের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে এই ভাষা সংরক্ষনে সরকারকে এগিয়ে আসার দাবি করেন।

শেরপুর আদিবাসী সমাজ উন্নয়ন সংস্থার কো-অর্ডিনেটর তাপস বিশ^াস বলেন, শেরপুর অঞ্চলের সাতটি নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মধ্যে মধ্যে ৪টির ভাষা হারিয়ে গেছে। কেবল মাত্র গারো, কোচ ও হজং এর ভাষা কোন রকমের টিকে আছে। আমাদেও হদি ভাষাটি ভারতের কিছু অঞ্চলের বোরো বাকাচারি ভাষা নামে পরিচিতি রয়েছে। আমি চেষ্টা চালাচ্ছি ওই ভাষার বর্ণমালা উদ্ধারের জন্য। তবে সরকারের সহযোগীতা ছাড়া এটা সম্ভব নয়।

শেরপুর আদিবাসী সক্ষমতা উন্নয়ন প্রকল্প (আইইডি) ফেলো সুমন্ত বর্মন বলেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আদিবাসী শিশুরা তাদেও সংস্কৃতিকে ধরে রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করতে উৎসাহ বোধ করেনা। আদিবাসী বিভিন্ন সংগঠন থেকে বিভিন্ন ভাষার হরফ উদ্ধারের চেষ্টা করা হচ্ছে। শেরপুরে আদিবাসীদের ভাষার সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। তাইভাষা ও সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে একটি কালচারাল একাডেমির অতি জরুরী।

এ ব্যাপারে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ওবায়দুল্লাহ বলেন, সরকারিভাবে গত দুই বছর যাবত গারো ভাষার প্রাক-প্রাথমিকসহ তিনটা শ্রেণীর তাদের নিজস্ব বর্ণমালার বই পাওয়ার কথা থাকলেও অদ্যবধি সে বই শেরপুরে পৌঁছায়নি। তবে আদিবাসী শিক্ষার্থীদেও জন্য বইয়ের চাহিদা প্রেরণ করা হয়েছে। খুব শীঘ্রই তা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

জেলা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, শেরপুর জেলায় সাতটি নৃ-গোষ্ঠীর প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বসবাস। এদের মধ্যে প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় ৫ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬শত এবং উচ্চ মাধ্যমিকে ১ হাজার। এছাড়াও বিভিন্ন কিন্ডার গার্ডেনে অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে। তবে সরকারী হিসেবে বাইরে তার অন্তত দুই গুন শিক্ষার্থী রয়েছে।