মো. আবুল কালাম আজাদ :
“শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন৷ তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল, হৃদয়ে লাগিল দোলা,জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা৷ কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী?”
একটি জনসভায় নেতা কী বলেন, তা শোনার জন্য পাঁচ দিন চার রাত কোটি কোটি মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে . . . এমন নজির সম্ভবত পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। বাঙালির ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর একাত্তরের ৭ মার্চের সে রকম একটি ভাষণ। তাঁর কণ্ঠস্বর তেজোদীপ্ত, তাঁর বক্তব্য সুস্পষ্ট, ছন্দময় শব্দ গাঁথুনি। জীবদ্দশায় অসংখ্যবার তিনি বিভিন্ন জনসভায় বাংলার মানুষের বঞ্চনার কথা এবং তাদের ন্যায়সংগত অধিকার আদায় করে মুক্তি অর্জনের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল জাতির কাছে নেতৃত্বের সুদৃঢ় অঙ্গীকার এবং একটি সিদ্ধান্ত সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের যেকোনো বিষয়ে আলোচনা ও সংলাপ হওয়া স্বাভাবিক। পাকিস্তান ছিল সামরিক জান্তাশাসিত রাষ্ট্র, যেখানে জনমতের কোনো মূল্য ছিল না। জনগণের নির্বাচিত নেতা হয়েও বঙ্গবন্ধুকে বসতে হয়েছে সামরিক শাসক এবং তাদের সহযোগী রাজনীতিকদের সঙ্গে, যাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ছিল না।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ২৩ বছর পর প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয় ১৯৭০-এ। জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৯টি আসন পায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ। সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি অনুযায়ী তাঁরই হওয়ার কথা পরিষদ নেতা এবং তিনিই গঠন করবেন সরকার। কিন্তু তার পরিবর্তে শুরু হয় ষড়যন্ত্র রক্তপাতের মাধ্যমে নির্বাচনের ফলাফলকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর প্রথাগত ভাষণ ছিল না। লাখ লাখ মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি যেন তাঁর বেদনা প্রকাশ করে কারও সঙ্গে কথা বলছিলেন। শুরুতেই তিনি বলেন, ‘আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।’ ৩ মার্চ পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হয়েছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা না করে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান তা স্থগিত করেন। প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শান্তিপূর্ণ অসহযোগের ডাক দেন।
২ মার্চ থেকেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় রক্তপাত শুরু হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ২ থেকে ৬ তারিখের মধ্যে শতাধিক মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাই বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেন, বাংলাদেশের ২৩ বছরের ইতিহাস ‘এ দেশের মানুষের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।’ তিনি বলেন, ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়।’
শাসকের কাছে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার মতামতের মূল্য নেই, তাঁর স্বগোত্রের ছোট দলের নেতার দাবি অগ্রগণ্য। বঙ্গবন্ধু জনতাকে বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম ১৫ ফেব্র“য়ারি তারিখে আমাদের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দিতে। তিনি আমার কথা রাখলেন না, রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা।’ ভুট্টোর কথামতোই ৩ মার্চ পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু সেটাও মেনে নিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে এবং আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনের মতেও যদি তা ন্যায্য কথা হয়, আমরা মেনে নেব।’
৭ মার্চ সাত কোটি মানুষ নেতার কণ্ঠে যে শব্দটি শোনার জন্য কান পেতে ছিল, সেই স্বাধীনতা’ শব্দটি বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়।
তিনি সরকারপ্রধানের সঙ্গে শুধু নয়, সংখ্যালঘু দলের নেতা ভুট্টো ও অন্যদের সঙ্গেও কথা বলেন। তিনি তাঁদের পরিষ্কার বলে দেন, সবার সঙ্গে আলোচনা করেই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবেন। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা আলোচনা করলাম, আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করব সবাই আসুন, বসুন। আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করব।’
ঢাকায় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক দলের সদস্যরা এসেছিলেন। ইয়াহিয়ার ষড়যন্ত্রের সহযোগী ভুট্টো আসবেন না বলে জানালেন। পশ্চিম পাকিস্তানে তিনিই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘পঁয়ত্রিশ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে এলেন। তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো, দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষের, দোষ দেওয়া হলো আমাকে।’ উচ্চশিক্ষিত ভুট্টো নির্বোধের মতো বলেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের এমএনরা ঢাকায় এলে তাঁদের হত্যা করা হবে। তিনি বলেছিলেন, ‘কসাইখানা হবে অ্যাসেম্বলি’। তাঁর এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেন বঙ্গবন্ধু। দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে অশান্তি ও গোলযোগ সৃষ্টির চেষ্টা চলছিল কায়েমি স্বার্থ থেকে। সেদিকে ইঙ্গিত করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘শত্রু পিছনে ঢুকেছে। নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু–মুসলমান যারা আছে
আমাদের ভাই, বাঙালি, অবাঙালি তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের উপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’ এই ভাষণের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি একবারও বলেননি যে তাঁর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক। বরং তিনি আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, দেশের মানুষের অধিকার চাই।’ দেশের মানুষের কী সেই অধিকার? সে অধিকার তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার, যে অধিকার থেকে তারা দীর্ঘদিন বঞ্চিত। যে অধিকারের জন্য তিনি লড়াই করেছেন ১৯৪৭ সাল থেকে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে বঙ্গবন্ধু জানতেন খুব ভালো। তারা হত্যার রাজনীতিতে অভ্যস্ত। বাঙালিকে পদানত রাখার কোনো চেষ্টাই তারা বাদ দেবে না। সেদিকে সতর্ক থাকার পরামর্শও দেন এবং বলেন, ‘এই দেশের মানুষকে খতম করবার চেষ্টা
চলছে বাঙালিরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন।’ পৃথিবীর কোনো দূরদর্শী নেতাই অন্তর্যামী নন যে শত্রু কতটা হিংস্র হতে পারে, তা তিনি আগাম বলে দেবেন। ২৫ মার্চের আগে কারও পক্ষেই কল্পনা করা সম্ভব ছিল না পাকিস্তানি জান্তার গণহত্যার মাত্রা কতটা হতে পারে এবং তাদের পৈশাচিকতার প্রকৃতি কী।
৭ মার্চ সাত কোটি মানুষ নেতার কণ্ঠে যে শব্দটি শোনার জন্য কান পেতে ছিল, সেই স্বাধীনতা’ শব্দটি বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়। তিনি বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তাঁর এই বাক্য উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র জনসভা সমর্থনসূচক ধ্বনিতে উত্তাল হয়ে ওঠে। নেতা এবং বাংলার মানুষ সমস্বরে বলে দেয়, তারা কী চায় এবং তার জন্য তারা যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত।
এই ভাষণের পর মানুষ যখন আত্মোৎসর্গ করতে প্রস্তুত, তারপর আর নতুন করে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার আবশ্যকতা ছিল না। আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য মানুষ অপেক্ষাও করেনি। বঙ্গবন্ধুই সেদিন বলেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার না–ও পারি...তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর কথা যথার্থ প্রমাণ করেছে। তারা দেখিয়ে দিয়েছে, রাইফেল, কামান কোনো মারণাস্ত্র দিয়েই তাদের দাবিয়ে রাখা যায় না। এই ভাষণের ৯ মাস পর অত্যাচারিত বাংলাদেশের মানুষ বিজয়ী বেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, আর পরাজিত পাকিস্তানি জান্তার সেনাপতি মাথা নিচু করে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষও করেন। সাবাস বাংলাদেশ এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয় !
(মো. আবুল কালাম আজাদ)
প্রাবন্ধিক ও গবেষক, বিটিভি বিতার্কিক
চেয়ারম্যান
ময়মন সিংহ ডিবেটিং সোসাইটি, ময়মনসিংহ।