=মম তালুকদার=
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব নীলা নিকেতন আমাদের এই বাংলাদেশ। আমরা যে দিকে তাকাই, সে দিকেই এর নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে বিমোহিত হই। মনে হয় প্রকৃতি আপন হাতে নিজের মনের মতো করে এদেশকে সাজিয়েছে। আর এই প্রকৃতির দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যগুলো দেখার জন্য মানুষ দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসে।
ভ্রমণ করতে কার না ভালো লাগে? সকলেই ভ্রমণ করতে পছন্দ করে। কিন্তু তেমন সুযোগ না পাওয়ায় বা ব্যস্ত থাকায় অনেকে ভ্রমণ করতে পারে না। আর এই ব্যস্থতা কাটিয়ে যখন তারা একটু অবসর সময় পায় তখনি ভ্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। নতুন স্থানে ভ্রমণের ফলে নতুন অভিজ্ঞতাও সঞ্চারিত হয়।
সকলের মতো আমিও খুব ভ্রমণপিপাসু কিন্তু সারা বছর বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে এত বেশি সময় পাই না। তবে ডিসেম্বর মাস থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত অনেকটা সময় পেয়ে যাই ভ্রমণের জন্য। এই সময়টায় প্রত্যেক বছরই বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাই। আর প্রত্যেক বছরের সূচনা হয় এই ভ্রমণের মাধ্যমে। ২০২৪ সালেও আমি ঢাকাসহ অনেক জায়গায় ভ্রমণ করেছি। কিন্তু সবচেয়ে ভালো লেগেছে মোহনগঞ্জে অবস্থিত হিজল বনে। সেখানে যেন বার বার শৈশবে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। হৃদয়পটে ভেসে উঠেছিল স্মৃতি জড়ানো হিরণময় মুহুর্তগুলো। ফেব্রুয়ারি ০৩ তারিখে আমার শৈশবের বিদ্যালয় অর্থাৎ দৌলতপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জনাব তানভীর হাসান স্যারের নেতৃত্বে পিকনিকের আয়োজন করা হয়েছিল। আমার ভাই ঐ স্কুলেই ৫ম শ্রেণিতে পড়ে। আর পিকনিকটা ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজিত করা হয়েছিল। সকল ব্যবস্থা শেষ করে ০১ তারিখে সকলকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল যে সাবই হিজল বনে যাবে। সেদিন রাতে ভাই এবং আম্মু এসে বলে তারা ০৩ তারিখ পিকনিকে যাবে। আমাকেও যেতে হবে কিন্তু হিজল বনে যাবে এই কথাটি আমার ভালো লাগেনি। হিজল বনে গিয়ে কী করব? এখানে কী আছে? কয়েকটা হয়তো গাছ আছে। আমি হিজল বনে কখনই যাইনি। তাই এসব ভেবেছিলাম। যাহোক হয়তো বা ঐ বনের টানে আমাকে ০৩ তারিখে পিকনিকে যেতে হয়েছিল। সকাল ৬.০০ টায় আমরা সকলেই স্কুলের মাঠে উপস্থিত হই। ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক সহ মোট ১২০ জন পিকনিকে গিয়েছিল। আমাদের যাওয়ার জন্য ১৬ টি অটো ভাড়া করা হয়েছিল। আমরা ৭টায় রওনা করেছিলাম। প্রথমে যেতে না চাইলেও পরে মনে হচ্ছিল জায়গাটায় হতো ভালো লাগবে। আমরা সবাই ৮.০০ টায় মধ্যে হিজল বনে পৌঁছে গেলাম। পৌঁছে আমি তো অবাক হয়ে গেলাম। ভেবেছিলাম বনটি সুন্দর না কিন্তু চারপাশটা হিজল গাছে ছেয়ে আছে যা দেখে অত্যন্ত সুন্দর লাগছিল। তাছাড়াও বনটিকে এতো ভালো লাগছিলো যে বলে বোঝানো সম্ভব না।
বাংলাদেশের প্রকৃতির অনন্য সৌন্দর্য্যের বিকাশ ঘটায় হিজল গাছ। বৈশাখ মাসে এই গাছে ফুল ফোটে। তখন এই বাগানকে হয়তো আরো সুন্দর লাগে। হঠাৎ করে মনে পড়ে যায় জীবনানন্দ দাশের লিখা যা তিনি হিজলের সৌন্দর্য্যে বিমোহিত হয়ে লিখেছিলেন-
“ পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে,
পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে......”
এবার সত্যিই মনে হচ্ছিল জীবনানন্দ দাশের লিখাটির সাথে আমার দেখা হিজল বনের মিল রয়েছে। মনে হচ্ছিল আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর জায়গা এটি। আর আমি এই জায়গাটিকে অসুন্দর ভাবছিলাম? এখনো বাগানটা ঘুরে দেখিনি। তবে বাগানটিতে ঢুকেই এতো ভালো লাগছিলো যে প্রকৃতি যেন তার সৌন্দর্য্য চাঁদের আলোর মতো চারপাশে ছড়িয়ে দিয়েছে। যাওয়ার পর পরই সকলে ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে গেল। মনে হয় ওদের সকলেও জায়গাটা অত্যন্ত ভালো লেগেছিল। আমিও কয়েকটা ছবি তুললাম। একটু পরই সকল শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে ঘুরাঘুরি শুরু করল। তাদের প্রায় সকলেই আমার খুব পরিচিত আর ৫-৬ জন মেয়ের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। আমিও তাদের সাথে পুরো বাগনটা ঘুরে দেখলাম। মনে হচ্ছিল আমিও তাদের সমবয়সী। কতই না সুন্দর ছিল ঐ শৈশবকল! হারিয়ে যাচ্ছিলাম তাদের মাঝে। জায়গাটা কিছুটা পাহাড়ি এলাকার মতো। শুধু তাই নয় প্রকৃতির এই নিবীড় পরিবেশে মন জুড়িয়ে যাচ্ছিল।
ঘুরতে ঘুরতে দুপুর হয়ে যাচ্ছিল। তারপর শুরু হয় মিউজিক। কয়েকজনের নাচ দেখে পুরোই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এরপর পরেই স্যার ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে ফুটবল খেলা শুরু করলেন। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। একসময় আমিও ফুটবল খেলতাম কিন্তু এখন আর খেলি না। কিছুক্ষণ পর এক ছেলে ঝালমুড়ি বিক্রি করতে আসে। ছেলেটির বয়স ১৪-১৫ হবে। তাকে দেখে অনেক কষ্ট লাগছিলো। এই বয়সে আমি পড়াশোনা করছি, ঘুরাঘুরি ও আনন্দে জীবন কাটাচ্ছি। আর ও কিনা অর্থের অভাবে ও সংসারের আয়ের জন্য শিশুশ্রমে লিপ্ত হলো! আমরা কখনই হয়তো তাদের কথা চিন্তা করিনা। আমি এসব ভাবছিলাম ঠিক এমন সময় স্যার এসে আমাকে ১২০ টা লটারির কাগজ তৈরি করতে বললেন। আমি তৈরি করতে শুরু করলাম কিন্তু কখন যে ছেলেটি চলে গেল বুঝতেই পারিনি। কোথায় আর যাবে? হয়তো এমন কোনো জায়গায় যাবে যেখানে ঝালমুড়ি বিক্রি করতে পারবে। তার মতো না জানি কত শিশু আজ দারিদ্র্যতার জন্য শিশুশ্রমে লিপ্ত হচ্ছে ভাবলেও কষ্ট লাগে।
দুপুরে খাওয়ার সময় হয়েছে। সকলেই একেক জায়গায় বসে খেতে শুরু করল। আমি কয়েকটা মেয়ের সাথে বসে খেতে শুরু করলাম। ঠিক ঐ সময় ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা আমর হৃদয়টাকে ছুঁয়ে যায়। একজন শিক্ষার্থী তার খাবারটি ভিক্ষারিকে দিয়ে দেয়। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া এই শিক্ষার্থীর মানুষের জন্য কত ভালোবাসা ভাবতেও অবাক লাগে। ২ প্যাকেট বিরিয়ানি বাড়তি আনা হয়েছিল। ওখান থেকে ১টা প্যাকেট ওকে দেয়া হয়। তার দয়া দেখে সকলেই খুব খুশি হয়েছিল এবং পরবর্তীতে তাকে পুরস্কৃত করা হয়।
তারপর শুরু হলো লটারি। লটারিতে অনেক মজা হয়েছিল। আমি একটি চিপস পেয়েছিলাম। সবাই অনেক আনন্দিত ছিল। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে চিপস খাচ্ছিলাম। গাছ থাকলে একটা জায়গা কতটা সুন্দর লাগে এখানে না এলে জানতে পারতাম না। ইচ্ছে করছে এখানে একটি ঘর তৈরি করে থাকি। কিন্তু মানুষ নাকি এই বৃক্ষ অবাধে নিধন করে চলছে! কিন্তু কেন তারা এই সৌন্দর্য্যকে নষ্ট করছে? শুধু তাই নয় এর ফলে জীববৈচিত্র্যও নষ্ট হচ্ছে। তাদের উচিত বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৈৗন্দর্য্য রক্ষায় অবাধে বৃক্ষ নিধন বন্ধ করা এবং বেশি করে গাছ লাগানো । তাহলেই আমাদের পৃথিবী অত্যন্ত সুন্দর হয়ে গড়ে উঠবে।
বিকেল ৪.০০ টায় দিকে আমরা রওনা হই। প্রায় ৫ টায় দিকে বাসায় এসে পৌঁছে যাই। হিজল বনকে অনেক মনে পড়ছিল। আর এর সৌন্দর্য্যে বিমোহিত হয়ে আমার মনে হচ্ছিল আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর জায়গা এই বন।
(মম তালুকদার
শিফট: প্রভাতি শ্রেণি: ৯ম, শাখা: ক, রোল- ০১
মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়
মোহনগঞ্জ, নেত্রকোণা)