স্টাফ রিপোর্টার : দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের দায়ের করা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পাঁচ মাস অতিবাহিত হলেও ময়মনসিংহের কোতোয়ালি মডেল থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-ওসি গোলাম সরওয়ার ও তাঁর ৩ পুত্রের বিরুদ্ধে চার্জশীটের মঞ্জুরী আদেশ হয়নি।

ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও মানিলন্ডারিংয়ের অপরাধ সংক্রান্ত অভিযোগের দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে দুদকের বিভাগীয় কার্যালয় ময়মনসিংহের উপ-পরিচালক তালেবুর রহমান মামলা সমূহের তদন্ত প্রতিবেদন মঞ্জুরীর আদেশের জন্য চলতি সালের গত জানুযারি মাসে ঢাকায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠান। কিন্তু গত পাঁচ মাসেও চাঞ্চল্যকর এই মামলার মঞ্জুরীর আদেশ হয়নি। এ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন উঠেছে।

এর আগে গোলাম সরওয়ার ও তার ৩ পুত্রের বিরুদ্ধে দুদক ময়মনসিংহ জেলা কার্যালয়ের সাবেক উপ-পরিচালক রাম প্রসাদ মন্ডল বাদী হয়ে তদন্ত নম্বর ১২(ময়মন) তারিখ ২৯/০৫/২২, তদন্ত নম্বর ১৩(ময়মন) তারিখ ২৯/০৫/২২, তদন্ত নম্বর ১৪(ময়মন) তারিখ ৩০/০৫/২২ ও তদন্ত নম্বর ১৫(ময়মন) তারিখ ৩০/০৫/২২ দায়ের করেন।

মঞ্জুরী আদেশ ঝুলে থাকায় নানা গুঞ্জন উঠতে শুরু করেছে। ওসি গোলাম সরওয়ার দম্ভ করে বলে বেড়াচ্ছেন সব কিছুই তিনি শেষ করে ফেলেছেন। এই মামলায় তার কিছুই হবে না।

দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের ময়মনসিংহ বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, মঞ্জুরী আদেশ হলেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।

দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের ময়মনসিংহ বিভাগীয় কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক ঋত্বিক সাহা এর আগে জানিয়েছিলেন, সাবেক ওসি গোলাম সরওয়ারের সম্পদ ক্রোকে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন পাওয়া গেছে। এখন যে কোন সময় এ ব্যাপারে ময়মনসিংহ আদালতে আবেদন করা হবে। বিজ্ঞ আদালত আবেদন মঞ্জুর করলেই সাবেক ওসি গোলাম সওরয়ারের সম্পদ ক্রোক করা যাবে। সম্পদ ক্রোকেও কোন অগ্রগতি নেই।

সব অভিযোগ অস্বীকার করে সাবেক ওসি গোলাম সরওয়ার জানান, ‘আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আদালতে কোন অভিযোগই প্রমাণ করতে পারবেনা দুদক’। বৈধভাবে উপার্জিত সমুদয় সম্পদের বিবরনী আদালতে তুলে ধরা হবে বলেও জানান তিনি। পারিবারিকভাবে পাওয়া সম্পদ বিক্রি ও পেনশনের টাকা দিয়েই সব সম্পদ অর্জন করেছেন বলে দাবি করেন তিনি।

স্থানীয় সূত্র জানায়, জ্ঞাত আয় বর্হিভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত ২০২২ সালের ২৯ ও ৩০ মে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম সরওয়ার এবং তাঁর তিন পুত্র এনামুল হক মাসুম, নাজমুল হক মারুফ ও মঞ্জুরুল হক মামুনের বিরুদ্ধে ময়মনসিংহের বিশেষ জজ আদালতে মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক।

দুদকের সমন্বিত ময়মনসিংহ জেলা কার্যালয়ের সাবেক উপ পরিচালক রাম প্রসাদ মন্ডল বাদী হয়ে এই মামলা দায়ের করেন। মামলায় গোলাম সরওয়ার ও তার ৩ পুত্রের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বর্হিভূত সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ আনা হয়। প্রাথমিক তদন্তে ৩ কোটি ৪৫ হাজার ৩৫৪ টাকার জ্ঞাত আয় বর্হিভূত সম্পদ অর্জনসহ মানিলন্ডারিংয়ের প্রমাণ পায় দুদক। এর মধ্যে গোলাম সরওয়ারের এক কোটি ৮৪ লাখ ৯৯ হাজার ৩৩ টাকা, পুত্র এনামুল হকের ৫৫ লাখ ৮৬ হাজার ৪৬৭ টাকা, নাজমুল হক মারুফের ৩০ লাখ ৫৬ হাজার ৯২৮ টাকা ও মঞ্জুরুল হক মামুনের নামে ২৯ লাখ ২ হাজার ৯২৬ টাকার জ্ঞাত আয় বর্হিভূত সম্পদের সন্ধান মেলে দুদকের অনুসন্ধানে।

অনুসন্ধানে দেখা যায় পুত্র এনামুল, নাজমুল ও মঞ্জুরুল অপ্রাপ্ত বয়স ও বেকার অবস্থায় এই সম্পদের মালিক হন। প্রচার রয়েছে, সাবেক ওসি গোলাম সরওয়ার পুত্রদের নামে থাকা সহায় সম্পদ নিজ নামে স্থানান্তরের পায়তারা চালাচ্ছেন।

গত ২০২২ সালের গত ১৫ জুন ময়মনসিংহের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক হেলাল উদ্দিন এর আদালতে গোলাম সরওয়ার আত্মসমর্পন করতে গেলে বিজ্ঞ বিচারক তাকে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বতর্মানে গোলাম সওরয়ার ৩ পুত্রসহ বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। পুলিশের কনস্টেবল থেকে পদোন্নতি পাওয়া ওসি গোলাম সরওয়ার ময়মনসিংহ কোতোয়ালি ও ভালুকা মডেল থানায় কর্তব্যরত অবস্থায় সম্পদের এই পাহাড় গড়ে তোলেন। ময়মনসিংহ নগরীর চরপাড়া নয়াপাড়া এলাকার ১০ তলা সৌহার্দ্য টাওয়ারের ১২ টি ফ্ল্যাট ও রাজধানী ঢাকার আদারের শেকেরটেক শ্যামলী হাউজিংয়ে আটতলা আলিশান বাড়ি ছাড়াও ময়মনসিংহ নগরীর কৃষ্টপুর, বলাশপুর, চুরখাই ও টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলার নিজ গ্রামে রয়েছে অগাধ সম্পদ। ওসি গোলাম সরওয়ার ও তিন পুত্রের জ্ঞাত আয় বর্হিভূত এই সম্পদ সরকারের জব্ধ করার দাবি উঠেছে।

media image
ছবি

জানা গেছে, সাবেক পুলিশ পরিদর্শক গোলাম সরওয়ার রাজধানী ঢাকার আদাবরের শেকেরটেক এলাকার শ্যামলী হাউজিং এর ছয় নম্বর সড়কে বি-৪৮ হোল্ডিংয়ে আট তলা বিলাস বহুল বাড়ি নির্মাণ করেছেন। স্থানীয়রা পুলিশ কর্মকর্তার বিলাসবহুল এই বাড়ি নির্মাণ নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছেন। ফ্য¬াটের বেশিরভাগ ভাড়া দেয়া হয়েছে। ময়মনসিংহে কর্মরত অবস্থায় গোলাম সরওয়ার এই বাড়িটি নির্মাণ করেন বলে জানায় স্থানীয়রা। এই বাড়ি করার সময় নানা গুঞ্জন ছিল। এখনও আছে। ঢাকার আদাবরের মতো এলাকায় জায়গা কিনে আটতলার বাড়ি করতে ২০-৩০ কোটি টাকা কী করে পেলো ওসি গোলাম সরওয়ার সেটিই বড় রহস্য। ঢাকার বাইরে ময়মনসিংহ নগরীর চরপাড়া নয়াপাড়া এলাকার ১০ তলা সৌহার্দ্য টাওয়ারে নিজ ও ৩ পুত্র এনামুল হক মাসুম, নাজমুল হক মারুফ ও মঞ্জুরুল হক মামুনের নামে ১২টি ফ্ল্যাট কিনেছেন। এসবের বাইরে ময়মনসিংহ নগরীর কৃষ্টপুর দৌলতমুন্সি রোডে ৪ শতাংশ জমিতে বাড়ি, বলাশপুর এলাকায় ১৫ শতাংশ জমি, শিকারীকান্দা এলাকায় ২০ শতাংশ জমি এবং টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলা সাব রেজিষ্ট্রার অফিসের পাশে ২০ শতাংশ জমিতে বাড়ি নির্মাণ করেছেন গোলাম সরওয়ার। নিজ গ্রামেও প্রচুর জমি কিনেছেন বলে জানিয়েছে এলাকাবাসী। এসব সম্পদের মূল্য অর্ধ শত কোটি টাকা বলে জানিয়েছে স্থানীয় সূত্র। এসবের বাইরে স্ত্রী সন্তানসহ নামে বেনামে আরও অগাধ সম্পদ রয়েছে সাবেক পুলিশ পরিদর্শক গোলাম সরওয়ারের।

পুলিশের এই কর্মকর্তা সর্বশেষ গত ২০১৫-২০১৬ সালে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানায় পুলিশ পরিদর্শক(ওসি) হিসেবে অবসরে যান।