হালুয়াঘাট প্রতিনিধি : রতন নামে এক প্রতিবন্ধীর ভাতার টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার ৯নং ধারা ইউনিয়নের সংরক্ষিত মহিলা আসনের ইউপি সদস্য নাসরিন আক্তার।
এ ঘটনার জের ধরে প্রতিবন্ধীর মাতা আয়েশা খাতুন নামে এক ভিক্ষুককে মারধর করে গুরুতর আহত করে ইউপি সদস্য নাসরিন।
পরে এ ঘটনায় মঙ্গলবার (২ জুলাই) রাতে হালুয়াঘাট থানায় ৪ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করেন ভিক্ষুক আয়েশা খাতুনের কন্যা রুমা আক্তার। মামলা নং ০১, তারিখ ২-০৭-২৪। এদিকে মামলা দায়েরের খবরে মুখ খুলতে শুরু করেছেন এলাকার বহু মানুষ।
স্থানীয়রা জানান, এলাকার বহু নিরীহ মানুষের নিকট থেকে ভাতার কার্ড করে দেয়ার কথা বলে লাখ লাখ টাকা আত্মসাত করেছেন উক্ত ইউপি সদস্য।
ইতিমধ্যে এমন অভিযোগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন স্থানীয় ২৪ জন ভুক্তভোগী। অভিযোগের প্রেক্ষিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আবিদুর রহমান আত্বসাতের ঘটনাটি তদন্তের জন্যে সমাজ সেবা কর্মকর্তা সানিয়াত সন্ধানীকে দায়িত্ব দেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আবিদুর রহমান বলেন, তদন্তে ভাতার টাকা আত্মসাতের প্রমান পাওয়া গেলে তাকে স্থায়ী ভাবে বরখাস্তসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জানা যায়, ৯নং ধারা ইউনিয়নের নারী ইউপি সদস্য নাসরিন আক্তার নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর থেকেই এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেন। স্থানীয় গরীব নিরীহ মানুষদেরকে নানাভাবে প্রলোভন দেখাতে শুরু করেন। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, টিসিবি’র পণ্যের কার্ড, টিউবওয়েল, স্বাস্থসম্মত লেট্রিন দেয়ার কথা বলে স্থানীয় শত শত মানুষের কাছ থেকে টাকা নেন। যা কয়েক লক্ষ টাকার মত হবে।
এ বিষয়ে স্থানীয় ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বললে, লালারপাড় গ্রামের ফরিদা খাতুন (৫০), জহুরা (৬০), মোতালেব (৫৮), ছানোয়ার (৪৫), তফাজ্জল শেখ (৬২), বোরহান আলী (৫৫), নিজ ধারা গ্রামের আছিয়া (৫২), শান্তা (৪৫), আয়েশা (৫০), রোজিনা (৫৪), রেহেনা (৫০), মুক্তা (৫০), সাহিদা (৪৮), রহিমা (৫৫), বীর গুছিনা গ্রামের রুমা (৩৪), আঞ্জুয়ারা (৫৪), পুতুল (৩০), মনোয়ারা (৫৬), পুর্ব ধারা গ্রামের প্রতিবন্ধী আবু তাহের (৪৮), প্রতিবন্ধী রিপা (৫৫), রুপবানু (৫৪), টিকুরিয়া গ্রামের মেহেদি (২৫) বলেন, ইউপি সদস্য নাসরিন প্রত্যেকের কাছ থেকেই ভাতার কার্ড করে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে টাকা নিয়েছেন। কারও কাছ থেকে দশ হাজার, কারও কাছ থেকে আট হাজার, কারও কাছ থেকে পাঁচ হাজার, কারও কাছ থেকে দুই হাজার করে টাকা নিয়েছেন।আবার কারও কাছ থেকে ছবি আর ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি নেন। কাউকে কার্ড করে দেন, আবার বেশির ভাগ মানুষকে কার্ড করে দেননি। অনেকের নামে কার্ড করে সেই কার্ডের টাকা, চাল নিজেই উত্তোলন করেছেন এমন অভিযোগও রয়েছে নাসরিনের বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি রতন নামে এক প্রতিবন্ধীর ভাতার টাকা উত্তোলন করতে গিয়ে প্রকাশ ঘটে ইউপি সদস্য নাসরিনের এমন অপকর্মের। এ ঘটনায় ২০ জুলাই বৃহস্পতিবার হালুয়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আবিদুর রহমানের নিকট ভুক্তভোগী রতনের ছোট বোন রুমা আক্তার একটি লিখিত অভিযোগও দায়ের করেছেন।বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত ও সরেজমিনে কথা বলে জানা যায়, নাসরিন বিভিন্ন সময়ে কৌশলে বিভিন্ন জনের নামে বয়স্ক ভাতা আর প্রতিবন্ধী ভাতার টাকা উত্তোলন করে আসছিল।
সম্প্রতি সময়ে বীরগুছিনা গ্রামের প্রতিবন্ধী রতনের ১০ হাজার ২ শত টাকা উত্তোলন করে নিয়ে যায় ইউপি সদস্য নাসরিন।ঈদুল আযহার পুর্বে তা টের পেয়ে উক্ত টাকা চাইতে যান প্রতিবন্ধী রতনের মাতা আয়েশা খাতুন। টাকা চাইতে গেলে তাকে পিটিয়ে মাথায় গুরুতর জখম করেন। গেল মঙ্গলবার রাতে হালুয়াঘাট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয় আয়েশাকে।
আয়েশা জানান, ইউপি সদস্য নাসরীনকে ৪ হাজার টাকা দিয়ে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করান। কার্ড করার সময় ইউপি সদস্য নাসরিনের এক আত্বীয় লালারপাড় গ্রামের বোরহানের কন্যা হেনার নাম্বার দেন। পরবর্তীতে হেনার কাছ থেকে দুইদিনের জন্যে সিম কার্ড নিয়ে টাকা উত্তোলন করে আত্মসাত করে ফেলেন। এক পর্যায়ে তা জানাজানি হয়ে গেলে উক্ত টাকা ফিরিয়ে দেন। লালারপাড় গ্রামের বোরহান বলেন, তিন দিনের জন্যে আমার মেয়ের কাছ থেকে সিম কার্ডটি চেয়ে নেন। কি কারনে নেন তা বলেননি। পরে শুনতে পান টাকা তুলেছেন।
স্থানীয়দের অনেকেই জানান, শুধুই প্রতিবন্ধী রতন নয়, এমন আরও বহু রতন রয়েছে যাদের কাছ থেকেই ভাতার কার্ড করার জন্যে তাকে টাকা দিতে হয়েছে।কেউ তার কাছে ভাতার কার্ড করার জন্যে সহযোগীতা চাইলেই তাকে টাকা দিতে হয়।অভিযোগ রয়েছে, একাধিক সিম কার্ড জমা রাখেন তিনি।কখনো কখনো নিজের আত্বীয় বা স্বজনদের ফোন নাম্বারে একাউন্ট খুলে সেই নাম্বার দিয়ে দেন ভাতার আবেদনে। পরে টাকা ঢুকলে কৌশলে তা আত্মসাত করে ফেলেন। আর যদি কখনো কেউ টের পেয়ে যায়, তাহলে কিছু টাকা ফিরিয়ে দিয়ে মিমাংসা করে ফেলেন। টিকুরিয়া গ্রামের মেহেদি নামে আরেক প্রতিবন্ধী জানান, ঈদের আগে তার নামে ১০ হাজার ২ শত টাকা ভাতা আসে। পরে উক্ত ভাতার টাকা উত্তোলন করে নিয়ে যান নাসরিন।পরে তা টের পেলে ৫ হাজার টাকা ফিরিয়ে দেন, আর বাকী ৫ হাজার ২ শত টাকা খরচের কথা বলে রেখে দেন।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত ইউপি সদস্য নাসরিন আক্তার তার বিরুদ্ধে অভিযোগটি সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বলেন, আয়েশাকে টাকার জন্যে নয়, তার সাথে অন্য বিষয় নিয়ে দ্বন্ধ হয়েছে। আয়েশাকে আঘাত সে নিজে করেননি বলে জানান। ভাতার পুরো টাকা নিজে উত্তোলন করলেও পরবর্তীতে তা রতকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
এ বিষয়ে হালুয়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আবিদুর রহমান বলেন, প্রতিবন্ধীদের কারও টাকা যদি ইউপি সদস্য তুলে থাকেন তাহলে অবশ্যই তার শাস্তি তাকে পেতে হবে। তিনি ঘটনাটি সমাজসেবা অফিসারকে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান।
হালুয়াঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহবুবুল হক বলেন, ভাতার টাকা উত্তোলনকে কেন্দ্র করে এক নারীকে পিটিয়ে আহত করার ঘটনায় হালুয়াঘাট থানায় মামলা হয়েছে। আসামীদেরকে আটকের চেষ্টা চলছে।