মেহেদী হাসান আকন্দ: রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ নিয়োগ ও আর্থিক দুর্নীতির মাধ্যমে ইসলামিক ফাউন্ডেশন নেত্রকোণা কার্যালয়ের উপপরিচালক (চ:দা:) শফিকুর রহমান সরকার গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী ময়মনসিংহ আর.কে মিশন রোড মসজিদ সংলগ্ন ৩৭৭০ নং দলিল মূলে শফিকুর রহমান সরকার ও তার স্ত্রী মরিয়ম আক্তারের নামে প্রায় কোটি টাকা মূল্যে নির্মিত বাড়িসহ ৪ শতাংশ জায়গা ক্রয় করেন। এছাড়াও নেত্রকোণা পৌর শহরের পূর্ব কাটলী এলাকায় ৫ শতাংশ জায়গা ক্রয় করে বাসা নির্মাণ করে গত জুলাই মাস থেকে পরিবারসহ বসবাস করছেন।
শফিকুর রহমান সরকার ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসের ২ তারিখে গবেষনা কর্মকর্তা হিসাবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে যোগদান করেন। যোগদানের মাত্র ১ মাস পরই ২০১৬ সালের জানুয়ারী মাসের ৫ তারিখে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে নিজ জেলায় সহকারী পরিচালক হিসাবে বদলী হন। আবার ২০২১ সালের অক্টোবর মাসের ১২ তারিখে একই কার্যালয়ে উপপরিচালক (চ:দা:) হিসাবে পদায়ন লাভ করেন। শফিকুর রহমান সরকার নেত্রকোণার দুর্গাপুর উপজেলার কেট্টা গ্রামের রুস্তম আলী সরকারের পুত্র।
শফিকুর রহমান সরকার নেত্রকোণা কার্যালয়ে যোগদানের পর থেকেই নিজেকে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি পরিচয় দিয়ে দাপটের সাথে বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে জামায়াত, বিএনপি ও হেফাজত ইসলামের ট্যাগ লাগিয়ে অন্যত্র বদলী করেন। ইসলামী ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে দেশব্যাপী ঈমাম-মুয়াজ্জিনদের নিয়ে আলোচনা সভায় জামায়াত, বিএনপি ও হেফাজত ইসলামকে আগুন সন্ত্রাসী ও দেশ বিরোধী আখ্যা দিয়ে তাদেরকে বয়কট করার আহবান জানান। এধরনের বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ভাইরাল হয়ে পড়ে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, শফিকুর রহমান সরকার আওয়ামীলীগের প্রভাব খাটিয়ে একক আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে নিয়োগ বাণিজ্য ও আর্থিক দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। জেলার ১০ টি উপজেলায় ১৯ টি দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদ্রাসায় শিক্ষক ও সহায়ক কর্মী কাম পরিচ্ছন্নতাকারী নিয়োগের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন লক্ষ লক্ষ টাকা। ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে প্রতিটি বিদ্যালয়ে বিদ্যুৎ বিল, বইপত্র ও সাময়িকী, স্ট্যাম্পও সীল, মনিহারী সামগ্রী, আসবাবপত্র মেরামত, পরিবহন ব্যয়, শিক্ষা ও শিখন উপকরণ, মুদ্রণ ও বাধাই, আসবাবপত্র, ভবন ও স্থাপনা মেরামত বাবদ ৭৯,৪৭০ (উনাশি হাজার চারশত সত্তুর) টাকা প্রদান করলেও ভাগাভাগির একটি বড় অংশ আসে তার পকেটেই।
সরেজমিনে, জেলার ১০ টি উপজেলায় ১৯ টি দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদ্রাসার মধ্যে নেত্রকোণার পূর্বধলা উপজেলার হলুদাটি গ্রামে গিয়ে হলুদাটি দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদ্রাসার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
হলুদাটি গ্রামের মৃত নওয়াব আলীর পুত্র আব্দুল হাই (৬৫) রাস্তার পাশে একটি পরিত্যাক্ত টিনের চালা ঘর দেখিয়ে বলেন, গ্রামবাসীর সহযোগীতায় এখানেই একটি বিদ্যালয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ঘরটির টিনের বেড়া এবং চালা বাতাসে উড়ে গেছে। কিছু বেঞ্চ পড়ে থাকলেও তা কোনো দিন ব্যবহার হয়েছে বলে মনে হয়না। এখানে বিদ্যালয়ের কোনো সাইনবোর্ডও নাই।
একই গ্রামের মৃত হোসেন আলী তালুকদারের পুত্র সিদ্দিকুর রহমান (৬৪) ও লাল মিয়ার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, গ্রামে কোনো বিদ্যালয় না থাকায় কয়েক বছর আগে এখানে একটি বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহম্মদ হোসেনের এপিএস এনামুল হককে সভাপতি করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ৩ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। সরকারি আর্থিক কোন সহযোগীতা না পাওয়ায় তারাও দীর্ঘদিন ধরে আর আসেনা। বিদ্যালয়ের জন্য নির্মিত ঘরটিও এখন পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে বলে তারা জানান।
খালিয়াজুরী উপজেলার মমিন নগর গ্রামে গিয়েও দেখা যায় প্রায় একই চিত্র। মমিন নগর গ্রামে মসজিদ সংলগ্ন টিনের বেড়ায় নির্মিত একটি বিদ্যালয় ভবন। সেখানেও বিদ্যালয়ে কোন সাইনবোর্ড লাগানো নাই। কোন শিক্ষক বা শিক্ষার্থীও উপস্থিত নাই।
মসজিদের ঈমাম সাহেব মজিবর রহমান জানান, বিদ্যালয়টিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে ২ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হলেও তারা বিদ্যালয়ে আসেননা।
মমিন নগর গ্রামের বাসিন্দা মৃত সফর আলীর পুত্র কিতাব আলী (৬২), মজিবুর রহমানের পুত্র আবুল কাশেম (৩০), আনু মিয়ার পুত্র সালেক মিয়া (৩৫), আব্দুল করিম মিয়ার পুত্র মুকুল হোসেন (২৭), আলকাস মিয়ার পুত্র রাসেল মিয়া (২৫), মৃত জলিল মিয়ার পুত্র আব্দুল করিম (৬৬), মৃত আব্দলু আজিজের পুত্র আব্দুল খালেক (৬০), মৃত মালু মিয়ার পুত্র আলাল মিয়া (৫৫) জানান, হাওর অধ্যুষিত গ্রামটিতে শিশুদের শিক্ষার জন্য নিজেদের উদ্যোগে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। বিদ্যালয়টিতে প্রায় ১২০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।
বিদ্যালয়ের সভাপতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আলাল মিয়া জানান, বিদ্যালয়টিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে ২ জন শিক্ষক ও ১ জন সহায়ক কর্মী কাম পরিচ্ছন্নতাকারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ২ জন শিক্ষকের মধ্যে এস এম আব্দুল্লাহ আল মামুনের বাড়ি পূর্বধলা উপজেলার শ্যামগঞ্জে এবং মো. রিদ্বওয়ানুল হকের বাড়ি দুর্গাপুর উপজেলায়। নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের বাড়ি বিদ্যালয় হতে দুরবর্তীস্থানে হওয়ায় তারা বিদ্যালয়ে আসেননা। সহায়ক কর্মী কাম পরিচ্ছন্নতাকারী জরিনা আক্তারের কিশোরগঞ্জ জেলায় বিয়ে হওয়ায় তিনিও বিদ্যালয়ে আসেননা। খালিয়াজুরী থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ফিল্ড সুপারভাইজার ফোন দিয়ে বই আনতে বলে আমি নিজ খরচে বই নিয়ে আসি। মাওলানা রফিক নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি তার বাড়িতেই শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পাঠদান করেন। বিনিময়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিমাসে তাকে টাকা দেওয়া হয়।
আব্দুল করিমসহ একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেন, সহায়ক কর্মী কাম পরিচ্ছন্নতাকারী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষাগত যোগ্যতা কমপক্ষে এস.এস.সি পাশ থাকলেও জরিনা আক্তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি অতিক্রম করতে পারেনি। জরিনা আক্তার সভাপতির মেয়ে হওয়ায় শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও অনৈতিক উপায়ে নিয়োগ পেয়ে বিদ্যালয়ে না এসেও নিয়মিত বেতন-ভাতা উত্তোলন করছেন।
বিদ্যালয়ের সভাপতি আলাল মিয়া আরও জানান, বিদ্যালয় স্থাপনের পর হতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে কোন ধরনের আর্থিক সহযোগীতা তারা পাননি। তবে গত সপ্তাহে ইসলামিক ফাউন্ডেশন নেত্রকোণা কার্যালয়ের উপপরিচালক (চ:দা:) শফিকুর রহমান সরকার তাকে ফোন করে তার বাসায় যেতে বলেছেন।
মমিন নগর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মালেক বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন নেত্রকোণা কার্যালয়ের উপপরিচালক (চ:দা:) শফিকুর রহমান সরকারের সাথে অনৈতিক লেনদেনে মাধ্যমেই শিক্ষকগণ বিদ্যালয়ে না এসেও বেতন-ভাতা উত্তোলন এবং বিদ্যালয়ের উন্নয়নে সহায়তার সকল অর্থ উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন।
মমিন নগর দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদ্রাসায় নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক এস এম আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দকৃত ৫৮০০০ (আটান্ন হাজার) টাকা তিনি পেয়েছেন। এই টাকা তার যাতায়াত খরচ বাবদ। কিছু টাকা দিয়ে তিনি বেঞ্চ মেরামত করবেন। বিদ্যালয়ে না এসে নিয়মিত বেতন-ভাতা উত্তোলনের বিষয়টি তিনি সাক্ষাতে আলাপ করবেন বলে জানান।
পূর্বধলা উপজেলার হলুদাটি দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষক তরিকুল ইসলাম জানান, ঝড়ে বিদ্যালয়টির টিন উড়ে গেছে। মেরামতের জন্য কিছু টাকা আসছে, অল্পদিনেই মেরামত করা হবে। মেরামতের জন্য কতো টাকা আসছে এবিষয়ে তিনি কিছুই জানেননা। কতোদিন ধরে বিদ্যালয়ে আসা হয়না এমন প্রশ্নের জবাব না দিয়েই ফোনের সংযোগ বিছিন্ন করেন।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন নেত্রকোণা জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক (চ:দা:) শফিকুর রহমান সরকার বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজতের বিরুদ্ধে বক্তব্যের ভাইরাল হওয়া ভিডিও’র সত্যতা স্বীকার করে বলেন, তিনি ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। জেলায় ১৯টি দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও বিদ্যালয়ের অন্যান্য বরাদ্দ নিয়মিত প্রদান করেন বলে জানান।শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও বিদ্যালয়ের অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নেওয়া অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের বিদ্যালয়ে না যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি কিছুই জানেন না। ময়মনসিংহ শহরে বাড়িসহ জায়গা ক্রয় এবং নেত্রকোণা শহরের পূর্ব কাটলীতে জায়গা কিনে বাড়ি করার সত্যতা স্বীকার করে তিনি বলেন এছাড়াও তার আরও ৮ একর জায়গা রয়েছে।