আফজাল হোসেন, বারহাট্টা সংবাদদাতা : শালুক কুড়িয়ে অভাব লাঘবের চেষ্টা করছেন নেত্রকোণার বারহাট্টা উপজেলায় প্রায় তিন শতাধিক দরিদ্র পরিবারের সদস্য। বর্তমানে শালুক কুড়ানোকে অনেকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে।
শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে শাপলা-শালুক তুলে বাজারে বিক্রি করে সংসারের চাহিদা মেটাচ্ছে। এছাড়াও অন্যরা শালুক তুলে বিক্রয় না করে নিজেরা খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করছে। শালুক এখন আর গরীবের খাবার না। এটি এখন সৌখিন মানুষের খাবার। কারন প্রতি কেজি শালুক স্থানীয় বাজারেই বিক্রয় হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকায়।
একসময় নিম্নাঞ্চলের মানুষের ক্ষুধা নিবারণের শেষ অবলম্বন ছিল শালুক। হাওরাঞ্চলে বা নিম্নাঞ্চলে এই শালুকের আলোচনা করলে এখনও স্মৃতিচারণ করেন প্রবীন মানুষেরা। শালুক দেখলেই তাদের অভাবের কথা মনে পড়ে যায়। শালুক এখন সবার কাছে একটি সুস্বাদু খাবার হলেও বেশি দামের কারনে অনেকেই কিনতে পারে না ।
বর্ষার শুরুর দিকে শাপলা গাছের সাথেই শালুক গাছ বেড়ে উঠে। এই গাছের গোড়ায় জন্ম হয় কাল রংয়ের গুটি গুটি জলজ ফলটি। শালুক গাছ বর্ষাকালে এমনি এমনি জন্ম হয়। এর পিছনে কোন রকম পরিশ্রম করতে হয় না। কৃষকের কাছে শাপলা ও শালুক গাছ জঞ্জালের কারন। অনেকেই মনে করে শাপলা গাছের গোড়ায় শালুকের জন্ম হয়, আসলেই বিষয়টি এমন নয়। তবে শাপলা গাছের গোড়ায় যে কাল রংয়ের গুটি টি হয় সেটির স্বাদও অনেকটা শালুকের মতো।
বারহাট্টা উপজেলায় মোট বিলের সংখ্যা ৩৩ টি ও খালের সংখ্যা রয়েছে ২৭ টি । প্রতিটি বিলে শাপলা শালুকের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও উপজেলার আসমা ইউনিয়ন ও সদর ইউনিয়নের কয়েকটি বিলে ব্যাপক পরিমাণে শালুক উৎপাদন হয়। তার মধ্যে কলা ভাঙ্গা বিল, বড় বিল, মহিষ মারা বিল, শিংগুয়া বিল, অতিথপুর বিল, গুলিয়া বিল, বরাইদ্দা বিল, কইয়ের ডিম বিল উল্লেখযোগ্য।
শালুক উত্তোলনকারী শ্রীরামপুর গ্রামের নূর আহমেদ বলেন, অভাবের সংসার, কি করবো বিভিন্ন খাল বিল থেকে পানির কামড় খেয়ে শালুক তুলি। প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ কেজি শালুক তুলতে পারি। এগুলো পরিস্কার করার পর সিদ্ধ করে বাজারে বিক্রি করি। আমাদের বারহাট্টায় প্রতি কেজি শালুক ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি করা যায়। কিন্তু ঢাকায় এক কেজি শালুক ১৫০ টাকায় বিক্রি হয় বলে শুণেছি।
হরিয়াতলা গ্রামের আঃ রাজ্জাক বলেন, একসময় এই শালুক ছিল অভাবী মানুষের খাবার। কিন্তু বর্তমানে এই সুস্বাদু খাবারটির কদর বেড়ে গিয়ে সবার কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেছে। তিনি বলেন, শালুক একটি ঔষধি ফল। চুলকানি ও রক্ত আমাশয় নিরাময়ের জন্য ঔষধ হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও এটি মানবদেহে হজমশক্তি বাড়াতে সহায়তা করে, শরীরে পর্যাপ্ত শক্তি জোগায় এবং দ্রুত ক্ষুধা নিবারণ করে থাকে ।
তিনি আরও বলেন, কৃষি মৌসুমে ফসলের জমিতে অতিরিক্ত আগাছা নিরোধক কীটনাশক ব্যবহারের কারনে বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদের পাশাপাশি ধীরে ধীরে আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে চিরচেনা এই শালুক। তবে আমাদের এই মহিষ মারা বিলে কীটনাশক ব্যবহার করি না।
এই গ্রামের মারজান মিয়া বলেন, এই মহিষ মারা কলা ভাঙ্গা ও কইয়ের ডিম বিলে ১৫ থেকে ২০ টি পরিবার শালুক তুলে প্রতি মৌসুমে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা ইনকাম করে। আর অনেকেই আছে নিজের পেটের ক্ষুধা মেটাতে শালুক সংগ্রহে বিলে আসে। এই একটি বিলেই দেড় থেকে দুইশত মানুষ শালুক তুলে নিজেদের প্রয়োজন মেটায়।
হরিয়াতলা গ্রামের হাবিব মেম্বার বলেন, আমাদের গ্রামের রুবেল মিয়া, রহিমা আক্তার সহ ১৫ থেকে ২০ জন মৌসুমের শুরু থেকে শালুক তুলে সংসারের প্রয়োজন মেটায়। ভাদ্র মাস শেষ হওয়ার সাথে সাথে এই জমি গুলোতে আমন ফসলের জন্য প্রস্তুত করা হবে। আগামী এক সপ্তাহ পর শালুক আর পাওয়া যাবে না।
কৃষিবিদ হুমায়ুন কবির বলেন, শালুক জলজ উদ্ভিদের ফল।শালুক শাপলা ফুলের মাঝামাঝি অংশে জন্মানো এক ধরনের সবজি জাতীয় খাদ্য। শাপলা গাছের গোড়ায় একাধিক গুটির জন্ম হয় যা ধীরে ধীরে বড় হয়ে শালুকে পরিণত হয়। এটি বর্ষাকালে শাপলা গাছের সাথে হাওর,নালা, খাল-বিলে জন্মে। এটি রক্ষায় কীটনাশক ব্যবহার কমাতে হবে। প্রতি ১০০ গ্রাম শালুকে খণিজ পদার্থ ১.৩ গ্রাম,আঁশ ১.১ গ্রাম,খাদ্যপ্রাণ ১৪২ কিলো,ক্যালরি প্রোটিন ৩.১ গ্রাম,শর্করা ৩১.৭,ক্যালসিয়াম ৭৬ মিলিগ্রাম রয়েছে।এছাড়াও শালুক শীতলকারক, পিত্ত প্রশান্তিদায়ক, হৃদযন্ত্রের শক্তিদায়ক, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া নিবারক, আমাশয় ও পেট ফাঁপায় উপকারী।