মেহেদী হাসান আকন্দ: নেত্রকোণার বারহাট্টা উপজেলার বরইতলা এন আই খান উচ্চ বিদ্যালয়ের কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫০ লাখ টাকা। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ৩০ জুন শেষ হলেও প্রকল্পের কাজ এখনো শুরু হয়নি।

২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে উন্নয়ন সংশোধিত বাজেটে ‘ইউনিয়ন পরিষদ উন্নয়ন সহায়তা’ খাতের আওতায় ইউনিয়নের অনগ্রসরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং ডেঙ্গু মোকাবিলায় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের নিমিত্বে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, ইউপি-২ শাখা অফিস স্মারক নং ৪৬.০০.০০০০.০১৮.০২.০১১.২২ (অংশÑ২)-১১৮৭ তারিখ ১১-০৬-২০২৪ মূলে নেত্রকোণা সদর ও বারহাট্টা উপজেলায় ১০০ লক্ষ টাকাবরাদ্দ পান সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামীলীগ সরকারের সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ১৫৮ নেত্রকোণা-২ আসনের সংসদ সদস্য বীরমুক্তিযোদ্ধা মো. আশরাফ আলী খান খসরু।

এর মধ্যে ৫০ লক্ষ টাকা প্রদান করেন নেত্রকোণা সদর উপজেলার চল্লিশায় মায়ের নামে স্থাপিত হেনা ইসলাম কলেজে এবং ৫০ লক্ষ টাকা প্রদান করেন বারহাট্টা উপজেলায় বাবার নামে গড়তে যাওয়া বরইতলা এন আই খান উচ্চ বিদ্যালয়ে।

গত ১২ জুন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের নিজ প্যাডে ১৫৮ নেত্রঃ ০২-২০২৪-৪৮ নং স্মারকে বারহাট্টা উপেেজলাধীন বরইতলা এন আই খান উচ্চ বিদ্যালয়ের ভবন ও সীমানা প্রাচীর নির্মানের নির্মাণ সামগ্রী ও আসবাবপত্র সরবরাহ করণে বারহাট্টা উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর ৫০ লক্ষ টাকার ডিও লেটার প্রেরণ করেন।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ১৯ জুন রহিমা ইন্টারপ্রাইজের প্রোপাইটার রফিকুল ইসলাম, আর এন ইন্টারপ্রাইজের প্রোপাইটার রাজন এবং আকন্দ কনস্টাকশনের প্রোপাইটর সাইফুল ইসলামকে ঠিকাদার নিয়োগ করেন। ৩ জন ঠিকাদারের নামে পৃথক ৫ টি কোটেশনের মাধ্যমে ২৪ জুন তারিখে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বরাদ্দকৃত সমূদয় টাকা উত্তোলন করা হয়েছে বলে সোনালী ব্যাংক বারহাট্টা শাখা থেকে নিশ্চিত করা হয়।

সরেজমিনে গিয়ে বরইতলা এন আই খান উচ্চ বিদ্যালয়ের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। এন আই খান উচ্চ বিদ্যালয়ের জমিদাতা আব্দুল মোতালেব ভূইয়ার পুত্র তানভীর ভূইয়া নিজেকে বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দাবী করে বলেন, সাবেক এমপি আশরাফ আলী খান খসরুর বাবা এন আই খানের নামে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার জন্য তার বাবা আব্দুল মোতালেব ভূইয়া ২০২১ সালে আথানগর মৌজায় ৩০ শতাংশ জমি দলিল করে দেন। তার বাবা মারা যাওয়ার পর চলতি বছরে ৩ ভাই ও ২ বোন মিলে একই দাগে আরও ১৯ শতাংশ জমি সাবেক সংসদ সদস্য আশরাফ আলী খান খসরুর নামে দলিল করে দেন।

তানভীর ভূইয়া আরো বলেন, ২০২১ সালে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস থেকে কিছু বই এনে স্থানীয় শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করা হলেও শিক্ষক নিয়োগে জটিলতা থাকায় তা আর বেশিদুর গড়ায়নি। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে এমপি মহোদয় টি আর কাবিখা প্রকল্পের মাধ্যমে ৫ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন, সেই টাকা দিয়ে জমিতে মাটি ভরাট করে রেখেছি। চলতি বছর এপ্রিল মাসে টি আর কাবিখা প্রকল্প হতে আবারো ৩ লক্ষ টাকা দিয়েছেন, সেই টাকার এখনো কোন কাজ করা হয়নি। শুনেছি এবার নাকি ৫০ লক্ষ টাকা এসেছে।

বিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড, অবোকাঠামো, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক না থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জটিলতা থাকায় এখনো শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। বিদ্যালয়ের ঘর নির্মাণ হলে আবারও শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রম শুরু করা হবে। বিদ্যালয়ের জন্য ভরাটকৃত জায়গায় থাকা ইটের শুড়কিগুলো বাউশী-মনাষ রাস্তা পাকাকরনের জন্য রাখা হয়েছে বলে তিনি জানান।

এন আই খান উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি জিয়াউল হক খোকন বলেন, কাজ এখনো শুরু হয়নি তবে প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত ৫০ লক্ষ টাকা ইউএনওর কাছে রয়েছে।

বারহাট্টা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের সুপারভাইজার শারমিন আক্তার বলেন, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এলপিআরে থাকায় জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা দায়িত্বে আছেন। তবে বরইতলা এন আই খান উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম তিনি প্রথম শুনলেন।

নেত্রকোণা জেলা শিক্ষা অফিসার মো. জুবায়ের ছাঈদ বলেন,বরইতলা এন আই খান উচ্চ বিদ্যালয়ের বারহাট্টা উপজেলায় কোন কোন বিদ্যালয় নাই। এই নামে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য পাঠদানের অনুমতি নাই। এমনকি ভবন নির্মানের জন্যও কোনো অনুমতি গ্রহণ করেন নাই।

আকন্দ কনস্ট্রাকশনের প্রোপাইটার সাইফুল ইসলাম বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানের নামে রফিকুল ইসলাম কাজটি নিয়েছেন। কাজ না করেই টাকা উত্তোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, টাকা উত্তোলন করতে অবশ্যই তার স্বাক্ষর লাগবে। কিন্তু তিনি কোথাও স্বাক্ষর করেননি।

প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োগ পাওয়া ঠিকাদার রহিমা ইন্টারপ্রাইজের প্রোপাইটার রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রকল্পের কাজ এখনো শুরু করা হয়নি। উপজেলা এলজিইডি অফিস থেকে বিল ভাউচার প্রস্তুত করে প্রকল্পে বরাদ্দকৃত টাকা উত্তোলন করেছেন। মালামাল সরবরাহের জন্য কয়েকবার অফিসে গিয়েও তাদের সহযোগিতা পাইনি। এলজিইডি প্রকৌশলী এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসার যেকোন সময় চাইলেই আমি মালামাল সরবরাহ করবো।

স্থানীয় ইউপি সদস্য দিলোয়ার হোসেন আক্ষেপ করে বলেন, কাজ না করেই জুন মাসে প্রকল্পের সমূদয় টাকা উত্তোলন কররেন আর কাজ না করেই টাকা ফেরৎ দিলেন সেপ্টেম্বর মাসে। কাজই করবেন না তাহলে টাকা কেন ক্যাশ করলেন।

স্থানীয় বাসিন্দা মঞ্জুরুল হক ভূইয়া বলেন, প্রতিষ্ঠানের কোন অস্তিত্ব না থাকলেও বরাদ্দ আসে। কিন্তু দৃশ্যমান কোন কাজ হতে দেখিনা।

সদর উপজেলা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোজাম্মেল হোসেন বলেন, গত জুন মাসে সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ আলী খান খসরু চল্লিশা হেনা ইসলাম কলেজে উন্নয়ন কাজের জন্য ৫০ লক্ষ টাকা প্রদান করেন। অর্থবছরের শেষ সময় হওয়ায় টাকাগুলো দ্রুত ক্যাশ করে রাখা হয়েছিল। কয়েকদিন আগেই টাকাগুলো ফেরৎ দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় (এলজিইডি)’র বারহাট্টা কার্যালয়ের প্রকৌশলী অমিত চন্দ্র দে কে অফিসে গিয়েও পাওয়া যায়নি। একাধিকবার তার মোবাইল ফোনে ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।

বারহাট্টা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা আক্তার ববি বলেন, বরইতলা এ আই খান উচ্চ বিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত ৫০ লক্ষ টাকা জুন মাসের ২৪ তারিখে ক্যাশ করা হয়েছিল। তবে চলতি সপ্তাহে টাকাগুলো ফেরৎ প্রদান করা হয়েছে।

নেত্রকোণা সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা তানিয়া তাবাসসুম হেনা ইসলাম কলেজে বরাদ্দকৃত ৫০ লক্ষ টাকা জুন মাসে ক্যাশ করা হয়েছিল বলে স্বীকার বলেন, চলতি সপ্তাহে এই টাকা ফেরৎ দেওয়া হয়েছে।