নেত্রকোনা প্রতিনিধি : ইসলামিক ফাউন্ডেশন নেত্রকোণা কার্যালয় পরিচালিত দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদ্রাসার নামে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন নেত্রকোণা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলার ১০টি উপজেলায় ১৯টি দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদ্রাসা ইসলামিক ফাউন্ডেশন নেত্রকোণা কার্যালয় কর্তৃক পরিচালিত হয়। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১টি, পূর্বধলা উপজেলায় ২টি, দুর্গাপুর উপজেলায় ২টি, কেন্দুয়া উপজেলায় ২টি, কলমাকান্দা উপজেলায় ৩টি, মোহনগঞ্জ উপজেলায় ২টি, বারহাট্টা উপজেলায় ১টি, আটপাড়া উপজেলায় ২টি, মদন উপজেলায় ২টি এবং খালিয়াজুরী উপজেলায় ২টি বিদ্যালয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৪০জন শিক্ষক ও ১৮ জন সহায়ক কর্মী কাম পরিচ্ছন্নতাকারীদের নামে নিয়মিত বেতন-ভাতা এবং বিদ্যালয়ের বিদুৎ বিল, শিক্ষা উপকরণ ক্রয়, আসবাবপত্র মেরামত, ভবন ও স্থাপনাসহ অন্যান্য মেরামত বাবদ নিয়মিত বরাদ্দ প্রদান করা হয়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, খালিয়াজুরী উপজেলার আসাদপুর গ্রামে শাহ বাবা নূর আলী ক্বারীর মাজার সংলগ্ন পরিত্যাক্ত একটি চালা ঘর। পরিত্যাক্ত এই ভবনটিতে কোন সাইনবোর্ড না থাকলেও ইসলামিক ফাউন্ডেশন নেত্রকোণা কার্যালয় পরিচালিত আসাদপুর দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদ্রাসা বলে নিশ্চিত করেন প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি আসাদপুর গ্রামের নূর ইসলাম। তিনি বলেন, গত ১বছরে এই বিদ্যালয়ে কোন শিক্ষককে আসতে তিনি দেখেননি। এমনকি বিদ্যালয়ে ২জন শিক্ষক ও ১ জন সহায়ক কর্মী কাম পরিচ্ছন্নতাকারী নিয়োগ দেওয়া হলেও তাকে অবগত করা হয়নি।
আসাদপুর দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষক মুহাম্মদুল্লাহ জানান, তিনি সদর উপজেলার সিংহের বাংলা দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদ্রাসায় চাকরি করতেন। তাকে বদলী করে আসাদপুর দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদ্রাসায় দেওয়া হয়েছে। তার গ্রামের বাড়ি জেলার কলমাকান্দা উপজেলায়।
একই উপজেলার মমিন নগর গ্রামে গিয়েও দেখা যায় প্রায় একই চিত্র। মমিন নগর গ্রামে মসজিদ সংলগ্ন টিনের বেড়ায় নির্মিত একটি বিদ্যালয় ভবন। সেখানেও বিদ্যালয়ে কোন সাইনবোর্ড লাগানো না থাকলেও ইসলামিক ফাউন্ডেশন নেত্রকোণা কার্যালয় পরিচালিত মমিন নগর দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদ্রাসা বলে নিশ্চিত করেন বিদ্যালয়ের সভাপতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আলাল মিয়া।
মসজিদের ঈমাম মজিবর রহমান জানান, বিদ্যালয়টিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে ২ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হলেও তারা বিদ্যালয়ে আসেননা। এছাড়াও মমিন নগর গ্রামের বাসিন্দা মৃত সফর আলীর পুত্র কিতাব আলী (৬২), মজিবুর রহমানের পুত্র আবুল কাশেম (৩০), আনু মিয়ার পুত্র সালেক মিয়া (৩৫), আব্দুল করিম মিয়ার পুত্র মুকুল হোসেন (২৭), আলকাস মিয়ার পুত্র রাসেল মিয়া (২৫), মৃত জলিল মিয়ার পুত্র আব্দুল করিম (৬৬), মৃত আব্দলু আজিজের পুত্র আব্দুল খালেক (৬০), মৃত মালু মিয়ার পুত্র আলাল মিয়া (৫৫) জানান, হাওর অধ্যুষিত গ্রামটিতে শিশুদের শিক্ষার জন্য নিজেদের উদ্যোগে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। বিদ্যালয়টিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে ২ জন শিক্ষক ও ১ জন সহায়ক কর্মী কাম পরিচ্ছন্নতাকারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ২ জন শিক্ষকের মধ্যে এস এম আব্দুল্লাহ আল মামুনের বাড়ি পূর্বধলা উপজেলার শ্যামগঞ্জে এবং মো. রিদ্বওয়ানুল হকের বাড়ি দুর্গাপুর উপজেলায়। নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের বাড়ি বিদ্যালয় হতে দুরবর্তীস্থানে হওয়ায় তারা বিদ্যালয়ে আসেননা। সহায়ক কর্মী কাম পরিচ্ছন্নতাকারী জরিনা বেগমের কিশোরগঞ্জ জেলায় বিয়ে হওয়ায় তিনিও বিদ্যালয়ে আসেননা। আনু মিয়ার পুত্র মাওলানা রফিক নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি তার বাড়িতেই শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পাঠদান করেন। বিনিময়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিমাসে তাকে টাকা দেওয়া হয়। আব্দুল করিমসহ একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেন, সহায়ক কর্মী কাম পরিচ্ছন্নতাকারী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষাগত যোগ্যতা কমপক্ষে এস.এস.সি বা সমমান পাশ থাকলেও জরিনা বেগম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি অতিক্রম করতে পারেনি। জরিনা বেগম সভাপতির মেয়ে হওয়ায় শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও অনৈতিক উপায়ে নিয়োগ পেয়ে বিদ্যালয়ে না এসেও নিয়মিত বেতন-ভাতা উত্তোলন করছেন।
বিদ্যালয়ের সভাপতি আলাল মিয়া জানান, বিদ্যালয় স্থাপনের পর হতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে কোন ধরনের আর্থিক সহযোগীতা তারা পাননি। খালিয়াজুরী থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ফিল্ড সুপারভাইজার ফোন দিয়ে বই আনতে বলে আমি নিজ খরচে বই নিয়ে আসি। গত কছুদিন আগে ইসলামিক ফাউন্ডেশন নেত্রকোণা কার্যালয়ের উপপরিচালক (চ:দা:) শফিকুর রহমান সরকার তাকে ফোন করে তার বাসায় যেতে বলেছেন।
খালিয়াজুরী উপজেলার ফিল্ড সুপারভাইজার মো. রেজুয়ানুল হক জানান, আসাদপুর ও মমিন নগর দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদাসায় ২জন করে শিক্ষক ও একজন করে সহায়ক কর্মী কাম পরিচ্ছন্নতাকারী নিয়মিত বেতন-ভাতা পান। বিদ্যালয়ের অবস্থা খুব একটা ভাল নয় বলে তিনি জানান। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা উপকরণ, ক্ষুদ্র মেরামত ও অন্যান্য ক্রয় বাবদ প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে ৮০ হাজার টাকা করে প্রদান করা হয়েছে। এই টাকাগুলো ইসলামিক ফাউন্ডেশন নেত্রকোণা জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক (চ:দা:) শফিকুর রহমান সরকার বিদ্যালয়ের ইনচার্জকে সরাসরি দেন। বিদ্যালয়ে শিক্ষক সহায়ক কর্মী কাম পরিচ্ছন্নতাকারী নিয়োগ ও বদলী ডিডি মহোদয় নিয়ন্ত্রণ করেন বলে তিনি জানান।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন নেত্রকোণা জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক (চ:দা:) শফিকুর রহমান সরকার জেলায় ১৯টি দারুল আরকাম ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও বিদ্যালয়ের অন্যান্য বরাদ্দ নিয়মিত প্রদান করেন বলে জানান। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও বিদ্যালয়ের অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নেওয়া অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের বিদ্যালয়ে না যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি কিছুই জানেন না।