মাজহারুল ইসলাম মিশু : ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি হালুয়াঘাট সদর ও কৈচাপুর ইউনিয়নের একাংশ ভেঙে ৯.২৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনে ‘গ’ শ্রেণীর মর্যাদা নিয়ে যাত্রা শুরু করে হালুয়াঘাট পৌরসভা।
৯টি ওয়ার্ডে ৪০ হাজারের অধিক মানুষের বাস এই পৌরসভায়। পৌরসভা গঠনের শুরুর দিকে সদর ও কৈচাপুর ইউনিয়নের সাথে সীমানা নিয়ে তৈরি হয় জটিলতা। যা গড়ায় আদালত পর্যন্ত। সীমানা জটিলতা কাটিয়ে চার বছর পর ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় পৌরসভার প্রথম নির্বাচন। ২০২২ সালের ২৮ শে নভেম্বর ‘গ’ শ্রেণী থেকে ‘খ’ শ্রেণীর মর্যাদা লাভ করে পৌরসভা। শুধু তাই নয় আয়তন বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১০.৫০ বর্গকিলোমিটার। ২০২৩ সালের ১৬ মার্চ দ্বিতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন। পৌরসভা হওয়ার পর দুটি নির্বাচনেই জয় পান তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ দলীয় প্রার্থী খায়রুল আলম ভূঞা। ২০২৪ সালের ১৮ আগষ্ট সরকারি প্রজ্ঞাপনে অপসারণের পূর্ব পর্যন্ত তিনিই পৌরসভার মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
পৌরবাসীর অভিযোগ, রাস্তাঘাট, ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও জলাবদ্ধতাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত পৌরসভাটিতে সরকারি দলের মেয়র থাকা সত্যেও কাক্সিক্ষত উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তারা। দীর্ঘসময় পার হলেও পৌরসভার নেই নিজস্ব ভবন। ভাড়া বাসায় চলছে পৌরসভার কার্যক্রম। শহরের প্রাণকেন্দ্র কাঁচা বাজার, মধ্য বাজার, শুটকি মহল, উত্তর বাজারসহ পৌরশহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে নাগরিক বর্জ্য অপসারণ করে সংগ্রহ করে তা ফেলা হচ্ছে শহরের কেন্দ্রীয় গোরস্থান এলাকার ব্রীজের নিচের দর্শা নদীতে। এতে করে দূষণে-দুর্গন্ধে একদিকে যেমন বিপন্ন হচ্ছে নাগরিক জীবন, অন্যদিকে নদীটি পৌরশহরের ময়লা ফেলার কারণে নদীটি হুমকির মুখে পড়ছে। জমি অধিগ্রহণ করে ময়লা ফেলার জন্য কোন ব্যবস্থা নেয়নি পৌরসভা কর্তৃপক্ষ। উত্তর বাজার শহীদ মিনার এলাকায় অবস্থিত ধান মহল থাকার কারণে যানজট যেন নিত্য সঙ্গী। কোন বাইপাস সড়ক না থাকার কারণে গোবরাকুড়া ও কড়ইতলী স্থলবন্দর থেকে কয়লাবুঝায় ট্রাক শহরের ভেতর দিয়েই চলাচল করে। ফলে যানজট আরো তীব্র আকার ধারণ করে।
হালুয়াঘাট পৌরসভার তথ্যমতে, পৌর এলাকায় মোট রাস্তা রয়েছে ৪০ কিলোমিটার। এরমধ্যে মাটির রাস্তা ৩০ কিলোমিটার। হেরিং বোন বন্ড (এইচবিবি) প্রকল্পের রাস্তা রয়েছে ১০ কিলোমিটার, যা বেশীরভাগ ভাঙা অবস্থায় রয়েছে। পৌরসভা ঘোষণার পর থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র ৪ কিলোমিটার রাস্তা পিচ ঢালাই (কার্পেটিং) করা হয়েছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা আরো বেহাল। পৌর শহরটিতে ৫১৫ মিটার আরসিসি ডালাইয়ের ড্রেন রয়েছে। এছাড়া ইটের গাঁখুনি ড্রেন রয়েছে ৩ কিলোমিটার। যা একটি পৌরসভার জন্য অত্যন্ত কম। হালুয়াঘাট পৌরসভা যেখান থেকে শুরু হয়েছে তার কোন গেইট বা সীমানার চিহ্ন এখন পর্যন্ত করা হয়নি। ফলে পৌরসভার বেশীরভাগ নাগরিক জানে না, কোন জায়গা থেকে হালুয়াঘাট পৌরসভার শুরু।
সরজমিনে ঘুরে দেখা যায়, পৌরসভার গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর বেহাল অবস্থা। উত্তর বাজার ধানমহল জামে মসজিদ থেকে ডাকঘরের সামনের সড়কটি বেহাল অবস্থায় পড়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। এটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের হওয়ায় পৌরসভা সড়কের সংস্কারে কাজ করেনি। ৬০ ফুট প্রসস্ত সড়কটির দু’পাশ দীর্ঘদিন ধরে দখল হতে হতে এখন সরু রাস্তায় পরিণত হয়েছে। অথচ এই সড়কটি দিয়ে প্রতিদিন বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীসহ আশেপাশের কয়েক এলাকার হাজারো মানুষ চলাচল করে। দূর্ভোগের এখানেই শেষ নয়। এই সড়কে একটি কালভার্ট ভাঙা দীর্ঘদিন ধরে। সেটির উপর স্টিলের পাত বসানো, যা দিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষের। পৌর শহরের কাঁচা বাজার থেকে মডেল মসজিদেও সামনের রাস্তা, মহাসড়ক থেকে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনের রাস্তাটি শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। অথচ দীর্ঘ সময়েও এই রাস্তাগুলো দিয়ে কষ্টে মানুষ চলাচল করছে। এছাড়াও পৌরসভা ভবনের সামনের সড়কটিও ভাঙা অবস্থায় রয়েছে। এলাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডের রাস্তা ও অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণের ফলে শহরের ভেতরের রাস্তাগুলো খুবই সরু। একটু বৃষ্টিতেই শহরের বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে থাকে। এতে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। এগুলো সংস্কারে পৌরসভার পক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাসীন দলের মেয়র থাকা সত্যেও উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত রয়েছে পৌরসভাটি।
হালুয়াঘাট ব্যবসায়ী উন্নয়ন সমিতির সভাপতি নাদিম আহমেদ বলেন, হালুয়াঘাট পৌরশহরের মানুষ নাগরিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আমাদের পৌরশহরের অনেক এলাকায় শীতকালে বিশুদ্ধ পানির সংকট তৈরি হয়। কিন্তু পৌরসভার পক্ষ থেকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের বিষয়ে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। শহরের ময়লাগুলো ফেলা হয় নদীতে। এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই নদী ভরাট হয়ে যাবে।
কেন্দ্রীয় গোরস্তান মসজিদের মোয়াজ্জিম মো. মাহফিজুল ইসলাম বলেন, আমাদের মসজিদে ময়লার দূর্গন্ধে মুসুল্লিরা নামাজ পড়তে পারেনা। এলাকার অনেকেই নদীতে ময়লা ফেলার জন্য নিষেধ করলেও পৌরসভা এই স্থানটিতেই ময়লা ফেলছে।
পৌরবাসিন্দা মনিরুল ইসলাম বলেন, আমাদের পৌরসভার চেয়ে ইউনিয়নের হাটবাজারগুলো অনেক ভালো আছে। এটিকে দেখলে কোন অবস্থাতেই পৌরসভা মনে হয় না। দীর্ঘবছরে আমরা উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আমরা চাই দখলমুক্ত ও পরিকল্পিত পৌরসভা। যেখানে সাধারণ মানুষ সকল নাগরিক সুযোগ সুবিধা পাবে।
পৌরসভার প্রশাসকের দায়িত্বে থাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবিদুর রহমান বলেন, পৌরসভার ময়লা যেন নদীতে ফেলা না হয় সে বিষয়ে আমরা বলে দিয়েছি। আর কোথায় কোন সমস্যা রয়েছে তা আমাদের নতুন এসিল্যান্ড আসলে আমরা পরবর্তীতে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।