শফিউল আলম লাভলু : শেরপুরের নকলা উপজেলা থেকে ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে বাঁশ ও ঐতিহ্যবাহী বেতশিল্প। বাঁশ ও বেতের তৈরি পণ্যের কদর আর তেমন নেই বললেই চলে। ঐতিহ্য হারাতে বসেছে এই শিল্পটি।

এক সময় গ্রামীণ জনপদের মানুষ গৃহস্থলি, কৃষি ও ব্যবসা ক্ষেত্রে বেত ও বাঁশের তৈরি সরঞ্জামাদি ব্যবহার করলেও, এখন বিলুপ্তির পথে এ শিল্পটি। এদিকে বাঁশ ও বেতের কারিগররা বলছেন সরকার আমাদের স্বল্প সুদে ঋণ ও কারিগরি প্রশিক্ষন দিলে এই শিল্পটি টিকিয়ে রাখতে পারব।

এক সময় বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালতসহ কৃষি কাজের সবখানেই ব্যবহার করা হতো বাঁশ ও বেতের তৈরি আসবাবপত্র। কয়েক বছর আগেও এ দেশের তৈরি বাঁশ ও বেতের তৈরি জিনিসের কদর ছিল। চেয়ার, টেবিল, বইয়ের সেলফ, মোড়া, কুলা, ঝুড়ি, ডোল, চাটাই থেকে শুরু করে এমনকি ড্রইংরুমের আসবাবপত্র তৈরিতেও বাঁশ ও বেত প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করা হতো। এ ছাড়া মাছ ধরার পলো, হাঁস, মুরগির খাঁচা, শিশুদের ঘুম পাড়ানোর দোলনা এখনো গ্রামাঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।

একসময় এ দেশের গ্রামাঞ্চলে বিপুল পরিমাণে এসব বাঁশ ও বেতের সামগ্রী তৈরি হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান হয়ে যেত। এখন সচরাচর গ্রামীণ উৎসব বা মেলাতেও বাঁশ ও বেতজাত শিল্পীদের তৈরি উন্নত মানের খোল, চাটাই, খালুই, ধামা, দোয়াড়, আড়ি, টোনা, আড়, হাপটা, পাল্লা, মোড়া, বুকসেলফ চোখে পড়ে খুব কম। যেখানে তালপাতার হাতপাখারই কদর নেই, সেখানে অন্যগুলো তো পরের কথা।

এখন সময়ের বিবর্তনে বদলে গেছে সবকিছুই। তারপরও নকলা উপজেলার নারায়নখোলা এলাকার বেপাড়ীপাড়ায় ৮৬৪টি পরিবার জীবন ও জীবিকার তাগিদে বাঁশ আর বেতের শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে এই উপজেলায় বাঁশ ও বেত শিল্পের তৈরি মনকাড়া বিভিন্ন জিনিসের জায়গা দখল করেছে স্বল্প দামের প্লাস্টিক ও লোহার তৈরি পণ্য। তাই বাঁশ ও বেতের তৈরি মনকাড়া সেই পণ্যগুলো এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে। তাই অভাবের তাড়নায় এই শিল্পের কারিগররা দীর্ঘদিনের বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অন্য পেশার দিকে ছুটছে। তবে শত অভাব অনটনের মধ্যেও আজও পৈতৃক এই পেশাটি ধরে রেখেছেন। তবে দিন দিন বিভিন্ন জিনিস-পত্রের মূল্য যেভাবে বাড়ছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে না এই শিল্পের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের মূল্য। যার কারণে কারিগররা জীবন সংসারে টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছেন।

নকলা উপজেলার নারায়খোলার বেপাড়ীপাড়া এলাকার বাঁশ ও বেত শিল্পের কারিগর রহমত উল্লাহ (৬০) বলেন, তাদের গ্রামে বেশকয়েকটি পরিবার এ কাজে নিয়োজিত আছে। অতি কষ্টে বাঁশ শিল্প টিকিয়ে রাখতে ধার-দেনা ও বিভিন্ন সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে কোনোরকম জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন।

media image
ছবি

নূরজাহান (৬৫) জানান, বিয়ে হয়ে আসার পর থেকেই গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরি কুলা, চালুন, মোড়া, বই রাখার তাক, চেয়ারসহ বিভিন্ন ধরনের বাঁশ ও বেত সামগ্রী কালের বিবর্তনে হারানোর পথে। এ শিল্প রক্ষায় কাউকে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না।

নাজমা বেগম (২৫) বলেন, বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি ধরে রাখতে অনেক ত্যাগ, কষ্ট, দুঃখ সহ্য করে যাচ্ছি। তবে বাঁশ ও বেতের ঝাড় উজাড় করার ফলে কত দিন এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি টিকে থাকবে, তা নিয়ে তাদের মধ্যে নানা প্রশ্ন ও সংশয় দেখা দিয়েছে।

শিরিনা বেগম (৫৫) বলেন, সরকার যদি আমাদের স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে আমরা এ পেশাটাকে ধরে রাখতে পারব এবং সন্তানদের স্কুলে পড়ালেখা করাতে পারব। তানা হলে ভিন্ন পেশায় আমাদের চলে যেতে হবে।

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. রুমান হাসান বলেন, আমরা বাঁশ বেত শিল্পের কারিগরদের নামের তালিকা করেছি। তালিকা অনুযায়ী এসব জনগোষ্ঠির জীবনমান উন্নয়নের জন্য দেওয়া হয়েছে ওস্তাদ-সাগরেদ প্রশিক্ষন। প্রশিক্ষন শেষে দেওয়া হয়েছে আর্থিক অনুদান। বর্তমানে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ। কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। যদি পুনরায় আবার এই প্রকল্প আসে তাহলে এসব জনগোষ্ঠির জীবনমান উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষন দিয়ে আরো দক্ষ করে গড়ে তুলব।