এ টি এম রবিউল করিম : মহান মুক্তিযুদ্ধে ময়মনসিংহ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় এবং ব্যয় বহুল যুদ্ধ ছিল ফুলপুরের বাখাই - মধ্যনগর যুদ্ধ। এ যুদ্ধটি ডিসেম্বর মাসের ৬ থেকে ৮ ডিসেম্বর '৭১ তিনদিনব্যাপী বিস্তৃতি ছিল। যুদ্ধের শেষ দিন ৮ডিসেম্বর বুধবার বাখাই - মধ্যনগর নামক স্থানে ইয়াসিন শেখ ও রিয়াজ উদ্দিনের বাড়ির সামনে টহলের সময় পাকি বাহিনীর মুখোমুখি হয়ে যায় মুক্তি বাহিনীর কয়েকজন মুক্তিসেনা। কয়েকজন সরে যেতে পেলেও ধরা পড়ে যান দুইজন। একজন মুক্তিসেনা ও অপর জন যৌথ বাহিনীর ভারতীয় শিখ সেনা। শিখ সেনাকে বেয়নেটের আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত জখম করে চরম নির্যাতন শেষে গুলি করে হত্যা করে পাকহানাদার বাহিনী। পাকহানাদার বাহিনীর অপর একটি দল গেদু মিয়ার বাড়ি থেকে গেদু মিয়াসহ অন্য একজন এ দেশীয় মুক্তি সেনাকে আটক করে।
তাঁদেরকে চাদর দিয়ে হাত ও মুখ বেঁধে ফেলে। বাঁধা অবস্থায় গেদু মিয়া পাকিদের নিকট থেকে ছাড় পাওয়ার জন্য হাতাহাতি শুরু করলে তাঁকেও গুলি করে হত্যা করে পাকি বাহিনী। মুহুতে শুরু হয়ে যায় দু 'পক্ষে যুদ্ধ। মুক্তিবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে ৮০/৯০জন পাকি সৈন্য মারা যায়। গুলি বিনিময় চলছে। বীরমুক্তি সেনানী আবুল কাশেম দেখেন তাঁরা পাকিদের নাগালের মধ্যে।সামনে পাকি বাহিনী পিছনে সঙ্গীয় ২/৩ শত জন মুক্তিসেনা। মুহুতে সিদ্ধান্ত নেন সঙ্গীয় সাথীদের বাঁচাতে হবে। সাথী মুক্তি সেনানীদেরকে নিরাপদে সরে যেতে বলে, নিজের জীবন বাজি রেখে আবুল কাশেম শুরু করেন গুলি। আবুল কাশেম ও তাঁর সাথীদের গুলিতে মারা যায় অসংখ্য পাকি সৈন। অপর দিকে নিরাপদে সরে যেতে থাকেন মুক্তি বাহিনী। এভাবে চলে কিচ্ছুক্ষণ গুলি বিনিময়। তারপর মুক্তি বাহিনীর দিক থেকে গুলির সংখ্যা কমে যায়।
পাকহানাদাররা বুঝে যায় এখানে মুক্তি বাহিনী বেশী নেই। ইয়াসিন শেখের বাড়ির পশ্চিম দিকের জঙ্গলের একটি ব্যাঙ্কারে এল এম জি হাতে আবুল কাশেম পজিশন নিয়ে গুলি করে যাচ্ছেন। সাথী মুক্তিযুদ্ধাদের নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য আবুল কাশেম অকাতারে গুলি করে চলেছেন। এর অল্প সময়ের মধ্যে আবুল কাশেমের এল এম জি 'র গুলির শেষ হয়ে যায়। পাকি বাহিনী এক সময় দেখে আবুল কাশেম ব্যাঙ্কারে পজিশন নিয়ে আছে। কিন্তু কোন প্রতিরোধ বা গুলি আসছে না। আবুল কাশেমকে দেখা মাত্র বাশ ফায়ার করে হত্যা করে পাকিরা। রাগে অসংখ্য গুলি করা হয় আবুল কাশেমের নিথর দেহে। পাকিদের গুলি যেন থামতেই চায় না। তখন পাকিরা সংখ্যায় মাত্র ৮/১০ জন। যে কিনা নিজের জীবন বাজি রেখে অন্যদের জীবন রক্ষার্থে কোন কার্পণ্য করেননি সে কিনা মাত্র কিছু গুলির জন্য নিজের জীবন হারালেন। নিজের জীবন বিলিয়ে অন্য সাথী ভাইদের জীবন রক্ষা করলেন। বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে আবুল কাশেম বুঝিয়ে দিলেন, কি করে দেশের জন্য জীবন দিতে হয়।
প্রতক্ষ্য দর্শীরা বলেন, আবুল কাশেমের জন্য ৪/৫ শত জন মুক্তিসেনা ও এলাকাবাসী বেঁচে যায়। আবুল কাশেম যদি নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ না করতো তা হলে মুক্তি বাহিনীর অনেক ক্ষতি হতো। এমনকি পাকিদের হাতে এই এলাকা ধ্বংসস্তুপে পরিনত হতো। পাকিরা তাদের নিহত সৈন্যদের গলা এবং পায়ে রশি ও কলা গাছের ডগা বেঁধে টেনে টেনে সরচাপুর ঘাটে পাকি ক্যাম্পের দিকে নিয়ে যায়।
৩০/৪০ মিনিট সময়ের মধ্যে মিত্র বাহিনীর নেতৃত্বে বিমান নিয়ে হামলা করে বর্বর পাক হানাদার বাহিনীর উপর। দুপুর পর্যন্ত চলে স্থল ও আকাশ পথে হামলা। পাক হানাদার বাহিনীর মারা যায় প্রায় ৪/৫ শত জন সৈন্য। অপর দিকে যৌথ বাহিনীর মারা যায় ২৫ জন। তাঁদের মধ্যে ১০ জন মুক্তি সেনা ও ১৫ জন মিত্র সেনা (ভারতী)। বাখাই-মধ্যনগর সিমানায় রাস্তার পাশে বাখাই গ্রামের রফিকুল ইসলামের বাড়ি সংলগ্ন স্থানে আবুল কাশেমসহ ৫ জনকে সমাহিত করা হয়। দুই দিন পর আবুল কাশেমসহ অন্যদের জানাজা পড়া হয়ে ছিল।
কয়েক দিন পর ভারতীয় শিখ সেনাকে মিত্র বাহিনীর মেজর হোসিয়ার সিংয়ের নেতৃত্বে সামরিক কায়দায় সরচাপুর গোদারাঘাটে সমাহিত করা হয়।
বাখাই-মধ্যনগর যুদ্ধে হেরে পাকি হানাদার বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে যায় এবং ময়মনসিংহের দিকে পালিয়ে যায়। ফুলপুুর পাক হানাদার মুক্ত হয় ৮ ডিসেম্বর বিকালে। রাজনৈতিক নেতাদের সিদ্ধান্তে ফুলপুুর মুক্ত দিবস পালিত হয় ৯ ডিসেম্বর। আগামীকাল ৮ ডিসেম্বর ফুলপুর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি অনন্য দিন।
আমাদের এই সমস্ত বিজয়ের কাহিনী বর্তমান প্রজম্মদের জানাতে হবে। স্থায়ী স্কুল-কলেজের ছাত্র- ছাত্রীদের জানাতে তাদের প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বলি মুক্তিযুদ্ধের কথা। শোনাই মুক্তির গান।
আব্দুল গনি শেখ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর পিতা ইয়াসিন শেখসহ অন্যদের সাথে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে আটক হয়ে ছিলেন এবং নির্যাতিত হয়ে মৃত্যুর দুয়ার থেকে বেঁচে এসেছেন। গত ০৩/১২/২০২০ তারিখ বৃহস্পতিবার বিকালে বেঁচে যাওয়া সেই ভাগ্যবান ব্যক্তি আব্দুল গনি শেখ জানান দুঃখগাথা বিজয়ের কাহিনী। আব্দুল গনিসহ অনেকই বলেন আমরা শুনেছি যুদ্ধে যারা অবদান রেখেছেন, তাঁদেরকে বিভিন্ন সম্মানজনক উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। কিন্তু আবুল কাশেমকে কোন উপাধি না দেওয়া আমাদের জন্য লজ্জাজনক। মুক্তিযুদ্ধে অনন্য বিশেষ অবদান রাখায় আমরা আবুল কাশেমকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করার জন্য আহবান জানান। এলাকাবাসীর ভাষ্যমতে আবুল কাশেম বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি পাওয়ার যোগ্য মনে করি।
আবুল কাশেমসহ শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবরটির অস্তিত্ব বিলিন হয়ে গিয়েছে। কবরের উপর গরু-ছাগলকে ঘাস খেতে দেখা যায়। শহীদের কবর পাকা করণসহ একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ জাতি প্রত্যাশা করে। বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী দেখবেন বলে ফুলপুরবাসী আশা করেন।