ডেস্ক রিপোট : নেত্রকোনায় পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনা উদ্বেগজনক রূপ নিয়েছে। জেলার গ্রামাঞ্চল, বিশেষ করে হাওরভিত্তিক উপজেলা ও জনবহুল ইউনিয়নগুলোতে শিশুরা পানিতে ডুবে মারা যাওয়াটা প্রায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ছয় মাসে সরকারী হিসেব অনুযায়ী অন্তত ৫০ জন পানিতে ডুবে মারা গেছেন, তবে প্রকৃত সংখ্যা এর থেকে অনেক বেশি বলে মনে করা হচ্ছে, কারণ অনেক পরিবার ময়নাতদন্ত ও আইনগত জটিলতার ভয়ে হাসপাতালে বা থানায় অভিযোগ দিচ্ছেন না।

জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত পানিতে ডুবে মৃতের সংখ্যা উপজেলাভিত্তিকভাবে: পূর্বধলায় ১০ জন, সদর উপজেলায় ১০ জন, মোহনগঞ্জে ৮ জন, বারহাট্টায় ৬ জন, কলমাকান্দায় ৭ জন, খালিয়াজুরীতে ৩ জন, দুর্গাপুরে ২ জন, কেন্দুয়ায় ২ জন, মদনে ১ জন এবং আটপাড়ায় ১ জন। বিশেষ করে কলমাকান্দা উপজেলা অতীতে শিশুমৃত্যুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। জেলা জুড়ে হাওরাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় এই ধরনের দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।

সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে: ১২ সেপ্টেম্বর খালিয়াজুরীর ধনু নদীতে তিন শিশু সহ চার জনের মৃত্যু, ২৪ সেপ্টেম্বর কেন্দুয়া উপজেলার মাসকা গ্রামে এক শিশুর পুকুরে ডুবে মৃত্যু, ৯ আগস্ট আটপাড়া এলাকায় বাড়ির সামনে পুকুরে তিন বছর বয়সী শিশুর মৃত্যু এবং ২৬ আগস্ট কলমাকান্দায় দেড় বছর বয়সী শিশুর মৃত্যু। শুধু জুলাই ও আগস্ট মাসে অন্তত ৯ শিশুর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে এবং বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে গত এক মাসে প্রায় ১৫ জনের মৃত্যুর তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। যদিও এসব তথ্যের বাইরে আরও অনেক ঘটনা ঘটে থাকে, যা প্রশাসনের নজর এড়িয়ে যায়।

কলমাকান্দা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ আল মামুন গনমাধ্যমকে জানান, হাসপাতালে যেসব রোগী আসে, সেগুলোই রেকর্ডে থাকে। গত জুলাই মাসে ৪ জন এবং আগস্টে ২ জন শিশুর লাশ হাসপাতালে আনা হয়েছে, যাদের মৃত্যুর কারণ পানিতে ডুবে যাওয়া বলে নিশ্চিত। তিনি জানান, দেড় থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে এই ধরনের দুর্ঘটনা বেশি ঘটে এবং সকাল ১১টা থেকে দুপুর পর্যন্ত সময় বেশি বিপজ্জনক, কারণ ওই সময়ে অভিভাবকরা অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকেন।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, সামান্য বৃষ্টি বা জলাবদ্ধতার সময় পুকুর, নদী ও খালগুলো আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। গৃহিণী অরণ্যা বেগম বলেন, “আমাদের ঘরের বাইরে কেউ নেই, সন্তানকে চেয়ে রাখার কেউ নেই, আর সাবধান হতে বললেও সময় থাকে না কয়েক সেকেন্ডেই দুর্ঘটনা ঘটে।

স্থানীয় স্কুল শিক্ষক আশিকুর রহমান বলেন, স্কুল বন্ধের সময় মাদ্রাসা, মেলা বা খেলাধুলার সময়ও শিশুরা ঠিকমত তত্ত্বাবধান পায় না। পুকুর ও খালের ধারে রাস্তা থেকে বাধা দেয়া প্রয়োজন।

গ্রামের যুবকরা মনে করেন, নদ-নালা ও খাল দ্রুত পরিষ্কার করে বাঁধ নির্মাণ করলে দুর্ঘটনা কমবে এবং সরকারি উদ্যোগ জরুরি।

বিশেষজ্ঞরা বারবার উল্লেখ করছেন, এই ধরনের মৃত্যুর মূল কারণ হচ্ছে অচেতনতা, পর্যবেক্ষণের অভাব এবং প্রয়োজনীয় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে গাফিলতি। শিশুর পরিচর্যার অভাব, নিরাপত্তাহীন জলজ পরিবেশ, উন্নয়ন প্রকল্পের অভাব এবং দুর্বল প্রশাসনিক তত্ত্বাবধান এ দুর্ঘটনার পেছনে মূল ভূমিকা রাখছে। তারা পরামর্শ দিচ্ছেন স্থানীয় সচেতনতা বৃদ্ধির কর্মসূচি, জীবন রক্ষাকারী প্রশিক্ষণ, জলাধার ও খাল রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তামূলক বেড়া বা বাঁধ নির্মাণ এবং স্কুল-মাদ্রাসায় জলবীমা ও সচেতনতামূলক শিক্ষা চালুর মাধ্যমে এই সমস্যা মোকাবিলা করতে।

নেত্রকোনার গ্রামজুড়ে শিশুমৃত্যুর ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য শুধু দাবি নয়, প্রয়োজন কার্যকর কর্মপরিকল্পনা ও জনসচেতনতা। শিশুর জীবন রক্ষা করা এখন সময়ের অত্যাবশ্যক দাবি, কারণ প্রতিরোধ করা সম্ভব এমন মৃত্যুর অপ্রয়োজনীয় ক্ষতি আর সহ্য করা যায় না।