কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি : কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস। সেখানে সেবা পেতে নেয়া হয় ‘চ্যানেল ফাইল’। আর এজন্য প্রতি আবেদন ফাইলে দিতে হয় এক হাজার ১০০ টাকা। এভাবেই প্রতিদিন গড়ে ৩ থেকে ৪ শত আবেদন ফাইলে নেওয়া হচ্ছে কয়েক লাখ টাকা। পাশাপাশি নির্ধারিত সময়ে পাসপোর্ট না পেয়ে চরম হয়রানির শিকার পাসপোর্ট প্রত্যাশীরা। সব মিলিয়ে পাসপোর্ট অফিসটি ঘুষ ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাসপোর্ট অফিসের আশপাশের কম্পিউটার দোকানকে কেন্দ্র করে মাদকসেবী ও দলীয় পরিচয় দানকারী স্থানীয় দালাল ও কম্পিউটার মালিকদের নিয়ে একটি দালাল সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। আর এই দালাল সিন্ডিকেটের সাথে পিয়ন, ঝাড়–দার ও কর্মচারীসহ পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালকের গোপন আঁতাত রয়েছে। এর ফলে সহজেই ঘুষের টাকা লেনদেন হয়। কিশোরগঞ্জ জেলা থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩ থেকে ৪ শত পাসপোর্ট আবেদন জমা হয় পাসপোর্ট অফিসে। এ আবেদনগুলি কম্পিউটারের দোকান থেকে অনলাইনে আবেদন করতে হয়।

আর এসব আবেদনের প্রিন্ট কপি জমার সময় ‘চ্যানেল ফাইল’ এ সিল মারা থাকে। পাসপোর্ট অফিসের ১০৭ নম্বর কক্ষে সিলমারা ‘চ্যানেল ফাইল’ সহজেই সাবমিট হয়ে যায়। আর কোনো আবেদন সিল ছাড়া জমা দিলে তা ভুল আবেদন দেখিয়ে ফেরত দেয়া হয়। এ কক্ষ থেকেই সিলমারা ‘চ্যানেল ফাইল’ এর হিসাব রাখা হয়। পরবর্তীতে ‘চ্যানেল ফাইল’ এর আবেদনগুলির ঘুষের এক হাজার ১০০ টাকা আদায় করে নেয় নির্ধারিত কর্মচারীরা।

এদিকে সব নিয়ম মেনে পাসপোর্ট আবেদন করে পাসপোর্ট প্রাপ্তির তারিখ অতিবাহিত হলেও পাসপোর্ট পায়নি বলে অভিযোগ করেন পাসপোর্ট আবেদনকারীরা।

এ ছাড়াও পাসপোর্ট করতে আসা নারী, শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরাও কাঙ্খিত সেবা পান না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হলেও তাদের কাজ শেষ হয় না। চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় তাদের। এ বিষয়ে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারিরা দায়িত্ব এড়িয়ে চলেন। কথা বলেও কাজ করানো যায় না, এমন অভিযোগ ভুক্তভোগিদের। ভুক্তভোগি কিশোরগঞ্জ মডেল থানার এস.আই পারভীন আক্তার বর্তমানে জজ কোর্টে কর্মরত। তিনি ২০২১ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে পাসপোর্টের আবেদন করেও আজও পাসপোর্ট পাচ্ছেন না। এ ব্যাপারে তিনি জানান, আমি শরীরিকভাবে অসুস্থ। পাসপোর্ট না পাওয়ায় দেশের বাহিরে চিকিৎসার নিতে পারছি না।

এদিকে রবিবার (৩০ অক্টোবর) পাসপোর্ট নিতে আসা কটিয়াদী উপজেলার পারদিয়াকুল গ্রামের বাবুল দাস জানান, ডেলিভারী স্লিপ নিয়ে সহকারী পরিচালক মোরাদ চৌধুরীর কাছে গেলে পাসপোর্ট পাবেন না বলে জানান। দুর্ব্যবহার করে তিনি আমাকে পাসপোর্ট অফিসে আসার জন্য নিষেধ করেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অনেক আবেদন ফাইল অফিসের জমা রাখা হয়। কিন্তু সেই আবেদন ফাইলগুলো কম্পিউটারে স্ক্যান ও এনরোলমেন্ট করা হয় না। তদবির ও সুপারিশের ভিত্তিত্বে আবেদন ফাইলগুলি ছাড়া হয়। এভাবেও পাসপোর্ট পেতে হয়রানির শিকার হন পাসপোর্ট প্রত্যাশীরা। আর পাসপোর্ট ডেলিভারি শাখায় ভোগান্তির শেষ নেই। ডেলিভারি স্লিপ সকালে জমা নেয়া হয়।

বিকেলে পাসপোর্ট ডেলিভারি না দিয়ে পরের দিন আসতে বলা হয়। এভাবেই হয়রানি করা হচ্ছে পাসপোর্ট ডেলিভারি শাখায়। তবে ডেলিভারি শাখায় দায়িত্বরত কর্মচারি ও আনসাররা এক থেকে দুই হাজার টাকায় রফা-দফা করে এক ঘণ্টার মধ্যেই পাসপোর্ট সাপ্লাই দেন। এমন অভিযোগ করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাসপোর্ট নিতে আসা ভুক্তভোগিরা।

পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মোরাদ চৌধুরী যোগদানের পর থেকে অফিস করেন না নিয়মিত। দেখা গেছে, সপ্তাহে দুই দিন অথবা তিন দিন অফিস করেন তিনি। পাসপোর্ট আবেদনকারীরা তাকে না পেয়ে ফিরে যান। আর তার নামে বরাদ্দ সরকারি মোবাইল ফোনে কল করেও পাওয়া যায় না। প্রায় সময়ই মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এসব নিয়ে পাসপোর্ট অফিসে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কোনো কিছুই কর্ণপাত না করে প্রভাবশালীর লোক পরিচয়ে তিনি পাসপোর্ট অফিস পরিচালনা করেন। তার দ্রুত পদোন্নতি হচ্ছে বা হবে এমন কথা প্রচার করেন তিনি।

এসব বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মোরাদ চৌধুরী। এ ব্যাপারে জেলা দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোঃ সালাহউদ্দিন জানান, কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের দুর্নীতির বিষয়ে আমাদের নজরদারীতে রয়েছে।